- ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব :
- ১১ মে ২০২৩, ১৫:৫২
মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর
মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর
মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর সব কিছুই ভাল লাগত। মেডিকেলের নতুন বন্ধুদের ভাল লাগত। মেডিকেলের পরিষ্কার ক্যাম্পাস ভাল লাগত। শহরের মানুষগুলোকে বেশ ভাল লাগত। শহরের এক কোণায় চিকলির বিলটাকে আরও ভাল লাগত। শুধু ভাল লাগত না মেডিকেলের রসকষ বিহীন পড়াশোনাটাকে।
এই ভাল না লাগা নিয়ে এক সময় পৌঁছে গেলাম থার্ড ইয়ারে। ক্লাসের বেঞ্চ ছেড়ে এবার সকাল-সন্ধ্যায় হাসপাতালের ওয়ার্ডে যাওয়া শুরু হল। ঐ প্রথম রোগীর সংস্পর্শে আসা। মানুষের এত এত কষ্ট, অসহায়ত্ব আর বাঁচার আকুতি ঐ প্রথম নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেলাম। রোগীর কষ্ট যেন আমার নিজের কষ্ট মনে হতে লাগল। ভাল না লাগার মেডিকেল ধীরে ধীরে ভাল লাগতে শুরু করল। মরিচীকার পিছে ছুটতে ছুটতে যেন সত্যিই শীতল পানির দেখা পেলাম।
একটা সময় এমবিবিএস পাশ করলাম। গাইনী ওয়ার্ডের ডিউটি দ্বারা ইন্টার্ণী লাইফ শুরু হল।
প্রথম সাত দিন ডিউটির পর চলে গেলাম শিশু ওয়ার্ডে। কিন্ত এই সাত দিনেই গাইনী ওয়ার্ডে ঘটে গেল একটি ঘটনা। মিতু নামের একটি রোগী মারা গেল। মিতু ছিল সাতাশ-আটাশ বছরের একটা বিবাহিত মেয়ে। স্বামীর বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। মিতু ছিল তার দ্বিতীয় স্ত্রী। মিতুর পেটে বাচ্চা এসেছিল। তবে তা জরায়ুতে ছিল না। ছিল জরায়ুর পাশের একটি নালীতে। যাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয়, " Ectopic Pregnancy ". অপারেশন করে তা অপসারণ করা হয়েছিল।
অপারেশনের পর আমি নিয়মিত মিতুর বেড ফলোআপ দিতাম। নিয়মিত dressing করতাম। অপারেশন পরবর্তী জটিলতার কারণে হঠাৎ একদিন রাতে মিতু বেশ খারাপ হয়ে গেল। আমি সে সময় ডিউটিতে ছিলাম না। সকালে মোবাইলে একটা কল আসল। রাতে যে ইন্টার্ণ ডাক্তার ছিল সে কল করেছে। "মিতুর অবস্থা বেশ খারাপ। মিতু আমাকে খুঁজছে।" আমি হাসপাতালের দিকে দৌড় দিলাম। মিতুর আশেপাশে আমাদের সি.এ ম্যাডাম সহ আরও কয়েকজন ডাক্তার দাঁড়ানো। মিতু কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেল।
নিজের চোখে প্রথম মৃত্যু দেখা। ডাক্তারী জীবনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলাম। মিতুর কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই তখনও বোঝেনি তার বোন মারা গেছে। সে আমাকে বলল,"ভাইয়া, কোন সমস্যা হয়েছে কি?" আমি নিঃশব্দে তার হাতটি ধরে হাসপাতালের বারান্দায় নিয়ে গেলাম। বুকে জড়িয়ে ধরলাম। মুহূর্তেই চোখ দুটো কান্নার পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল। কখন যে সে কান্নার সাথে শব্দ করে ফোঁপাতে লাগলাম- তা নিজেই টের পেলাম না। ছেলেটিও কাঁদছে, আমিও কাঁদছি।
আমার জীবনের সেটিই ছিল প্রথম ডেথ ডিক্লার। এভাবে কখনও ডেথ ডিক্লার করতে হয় না। এটা নিয়ম না। ডেথ ডিক্লার করতে ডাক্তারের মনটা বেশ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্ত রোগীর স্বজনকে জড়াজড়ি করে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করা বেশ বেমানান। কিন্ত আমি সেদিন মিতুর ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ সশব্দে কান্নাকাটি করেছিলাম।
মিতুই প্রথম। তারপর কতজনের মৃত্যু দেখেছি। কত মৃত্যু আমার হাতের উপর হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুই বেশ কষ্ট দেয়, মন খারাপ করে দেয়, কখনও চোখ ভিজিয়ে দেয়। কিন্ত সেদিনের মত কখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করিনি।
কিছু মৃত রোগীর চেহারা এখনও চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ভেসে ওঠে। কাজের অবসরে তারা যেন আমার পাশে এসে বসে, নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।
লেখক :
ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব
জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স
উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পত্নীতলা, নওগাঁ।