উড়ে যায় পক্ষী, রয়ে যায় পালক

উড়ে যায় পক্ষী, রয়ে যায় পালক

ডাক্তার
স্টেথোস্কোপ হাতে চিকিৎসক (ইনসেটে ডা. হাসান শাহরিয়ার কল্লোল) - ফাইল ছবি

গতকাল নাকি ছিল ডাক্তার দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি পালিত হয় সমাজে চিকিৎসকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য।

আমাদের দেশে তো চিকিৎসকদের আসলে তেমন কোন অবদান নাই! সে কারণে ঘটা করে এটা পালিত হয় না।

তারপরও এ পেশার আকর্ষণ থামেনা। যারা পেশায় আছেন তারা সহজে পেশা ছেড়ে যান না। আর নতুন নতুন হাজার হাজার ছেলে মেয়ে এ পেশায় আসে। ইতোমধ্যেই বাজারে চাকরি নেই চিকিৎসকদের। যাও আছে বেতন কড়ি খুবই কম। কোন কোন ক্ষেত্রে সভ্য সমাজে উল্লেখ করার মতোই না।

তাহলে কি আছে এই পেশার মধ্যে? এই প্রশ্ন মাঝে মাঝেই করি নিজেকে। আমার এই পেশায় আসার উদ্দেশ্য ছিল খুব সহজ। যদি কখনো চাকরি-বাকরি করতে মন না চায় সেক্ষেত্রে কারোর ধামা না ধরে স্বাধীনভাবে হয়তো পেটটা চালিয়ে নিতে পারব- এই সহজ ইন্সপিরেশনে এ পেশা বেছে নেয়া।

কিন্তু কাজ করতে করতে এক ধরনের নেশার মতো তৈরি হয়েছে। এটা হল মানুষকে রোগ মুক্ত করার নেশা। বিশেষত ক্যান্সার রোগের চিকিৎসক হবার পর থেকে এটা মনে হয় আরো বেড়েছে। প্রতিটা রোগী যখন ক্যান্সারের ডায়াগনোসিসের কাগজটা নিয়ে চেম্বারে ঢুকে, মনে হয় যেন তাদের অর্ধেক মৃত্যু হয়েছে। ক্যান্সারের ভয়াবহতা এবং এর সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণা গুলোই এর কারণ। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন তারা চিকিৎসার পথে এগোয়.. তারা আশায় বুক বাঁধে। চিকিৎসা শেষ হবার পর যেন আর একটু সাহস পায়। ফলোআপে যখন দুই তিন বছর পার হয়ে যায় তখন তারা আসলেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, হ্যাঁ এই রোগ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। তারা পরিকল্পনা করে সন্তান নেবার। নতুন একটা কাজে যোগ দেবার। আমার ফলোআপের রোগী গুলো তাই আমাকে আরো বেশি মোহগ্রস্থ করে এই পেশায়।

অথচ একটা অপারেশন করার পর থেকে রোগীটা সুস্থ হয়ে বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত যে পরিমাণ দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা ঘিরে থাকে, নিজের ভেতরে যে চাপ অনুভব করি সেটা কিন্তু অনেক সময়ই দারুন ক্লান্তিকর.. কিন্তু রোগী সুস্থ হয়ে উঠলেই তা রূপ নেয় এক অনির্বচনীয় আনন্দে।

সম্প্রতি একটি ঘটনা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমার এক রোগীনি কিছুদিন হলো গত হয়েছেন। উনার সার্জারি আমি করেছিলাম। এরপর থেরাপিও শুরু হয়েছিল থেমে থেমে। বয়স এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কারণে চিকিৎসা গুলো চলছিল গুটি গুটি পায়ে। কিন্তু এর মাঝে ই তিনি অসুস্থ হলেন এবং শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন।

মানসিকভাবে দারুন শক্ত ছিলেন। উনার দুই মেয়ে সব সময় উনার পাশে থেকেছেন। নানা সময়ে মেসেজে যোগাযোগ হয়েছে, ফোনে কথা হয়েছে উনার মেয়েদের সাথে উনার রোগ সম্পর্কে। আমার সীমার মধ্যে থাকলে পরামর্শ দিতে চেষ্টা করেছি।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস।

সেদিন হঠাৎ করে মেসেজ পাঠালেন যে উনারা দেখা করবেন। এলেন আমার চেম্বারে। তারপর যেটা বললেন বা করলেন সেটা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। আমার সেই রোগীনি সুস্থ হয়ে তার চিকিৎসকদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। দিতে চেয়েছিলেন উপহার। সে দেখা আর হয়নি আমাদের। কিন্তু দুই বোন মায়ের সেই উপহার নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। মায়ের হয়ে সেটা তুলে দেবার জন্য আমার হাতে। বাসায় এসে দেখলাম দারুন একটা হাত ঘড়ি। যে চলে যায় তাকে তো আর ধন্যবাদ দেয়া যায় না। কিন্তু দোয়া করা চলে। উনার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করেন।

সত্যি বলছি, আপনারা আছেন বলেই, আপনাদের ভালোবাসা আছে বলেই সম্ভবত এই মরার দেশে এত তীব্র আবেগ নিয়ে এই পেশাটায় টিকে আছি।

গত হওয়া ডাক্তার দিবসে আমার সব রোগীদের জন্য ভালোবাসা।

লেখকঃ 

ডা. হাসান শাহরিয়ার কল্লোল
সহকারী অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগ
কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজ।