চিকিৎসা পেশাকে কোনভাবেই উপভোগ করছি না

চিকিৎসা পেশাকে কোনভাবেই উপভোগ করছি না

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
সঠিক চিকিৎসার জন্য দরকার সুন্দর একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা - ফাইল ছবি

আমি একযুগ থেকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্র্যাকটিস করছি। অনেক ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকে চিকিৎসা পেশায় এসেছিলাম। কিন্তু এখন এই পেশাকে উপভোগ করছি না। কারন অনেক, দু-একটি বলছি-

১) আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রেফারেল সিস্টেম নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কি ধরনের রোগী দেখবেন, যারা বিশেষজ্ঞ নন তারা কি ধরনের রোগী দেখবেন; এসবের কোন বিভাজন নেই। যার কারনে সর্দি/কাশি হলেই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, মাথা ব্যথা হলেই নিউরোলিজিস্ট। আমি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে ধরনের রোগী দেখার কথা, সে ধরনের রোগী মাত্র ১০-২০% পাই। বাকী সব রোগী একজন এমবিবিএস ডাক্তার সুন্দরভাবে চিকিৎসা দিতে পারেন।

২) একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগী আসবে সাধারনত রেফার হয়ে। রেফার করবেন একজন এমবিবিএস চিকিৎসক বা জিপি। বর্তমানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগী রেফার হয়ে আসে, কিন্তু এই রেফার করে একজন নন-এমবিবিএস বা পল্লী চিকিৎসক, যারা সাধারনত এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। যেখানে পারসেন্টেজ বা সুযোগ- সুবিধা বেশি সেখানে রোগী নিয়ে যায়। কেউ যদি ইথিক্যাল প্র্যাকটিস করতে চান, তাহলে রোগী আপনার ধারে-কাছে আসবে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

৩) যে কোন রোগীর রোগ নিশ্চিত করতে হলে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার হয়। যেমন- পেটের ব্যথা হচ্ছে, এর সম্ভাব্য কারন হতে পারে- পেপটিক আলসার, পিত্তথলীর পাথর, প্যানক্রিয়েটাইটিস, এপেন্ডিসাইটিস, খাদ্যনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া, পাকস্থলীর ক্যান্সার ইত্যাদি। এই পেট ব্যথার কারণ কনফার্ম করতে হলে – USG of whole abdomen, ECG, Endoscopy of upper GIT, S. amylase, S. lipase, CT scan of the abdomen, CBC, RBS, creatinine, Urine R/E করা প্রয়োজন হয়। এগুলো পরীক্ষা করতে মোটামুটি ১৫-২০ হাজার টাকা লাগে। পৃথিবীর কোথাও রোগ কনফার্ম না করে চিকিৎসা দেয়া হয় না। আপনারা যাদের আত্নীয় স্বজন ইউরোপে আছে বা যারা ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের কাছে শুনে দেখতে পারেন। কিন্তু আমরা পরীক্ষা দিলেই বলা হয় পারসেন্টেজের জন্য এতগুলো টেস্ট দিয়েছে, ডাক্তাররা কসাই ইত্যাদি।

এখন আপনারা বলতে পারেন আমরা কিভাবে চিকিৎসা দেই। আমরা আমাদের অর্জিত বিদ্যা দিয়ে কি কি রোগ হতে পারে, আর কি কি হতে পারে না, তার লিস্ট করে, এক-দুটি পরীক্ষা করে তারপর চিকিৎসা করি। আপনারা যারা শিক্ষিত তারা গুগুলে সার্চ করে দেখতে পারেন, শুধু কিডনীর বা পিত্তথলীর পাথর কনফার্ম করার জন্য কি কি পরীক্ষা করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো- তাহলে ওইসব দেশের মানুষ কিভাবে এত খরচ বহন করে, উত্তর হলো- তাদের সব খরচ সরকার বা ইনস্যুরেন্স কোম্পানী বহন করেন।

৪) আমরা রোগীদের ফলোআপে আসতে বলি, বেশির ভাগ রোগী ফলোআপে আসে না। তাদের উত্তর-আমি সুস্থ আছি, তাহলে কেন আসবো? আপনি একজন রোগীকে প্রেসারের বা ডায়াবেটিসের ঔষধ দিয়েছেন, এই ঔষধ খেয়ে রোগী কেমন আছে? প্রেসার বা ডায়াবেটিস কন্ট্রোল আছে কিনা? কোন সাইড ইফেক্ট হচ্ছে কিনা? ইত্যাদি চেক করাই হলো ফলোআপ। কিন্তু আমাদের দেশের রোগীরা যতক্ষণ না বড় কোন সমস্যা হচ্ছে ততক্ষন ফলোআপে সাধারনত আসতে চায় না। যার ফলাফল ভয়াভয়, দেখা যায় প্রেসার বা ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে রোগী স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস বা কিডনী বিকল হয়ে আসে।

পরিশেষে বলবো, চিকিৎসকরা শুধু পারসেন্টেজ নেয়ার জন্য টেস্ট দেয় এই সব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। কিছু সংখ্যাক খারাপ চিকিৎসকের জন্য সবাইকে জেনারেলাইজড করা কোনভাবেই কাম্য নয়। সঠিক চিকিৎসার জন্য দরকার সুন্দর একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ভালো/দক্ষ চিকিৎসক এবং ভালো রোগী।

লেখকঃ

ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
প্রাইম মেডিকেল কলেজ
প্রতিষ্ঠাতা- ডাক্তারখানা (জিপি সেন্টার)