স্বাস্থ্য ক্যাডার মূল লক্ষ্য নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানই আমার পেশা এবং প্যাশন : ৪১তম বিসিএস এ দ্বিতীয় ডা. ফরিদা

স্বাস্থ্য ক্যাডার মূল লক্ষ্য নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানই আমার পেশা এবং প্যাশন : ৪১তম বিসিএস এ দ্বিতীয় ডা. ফরিদা

স্বাস্থ্য ক্যাডার
সম্প্রতি ৪১তম বিসিএসের প্রকাশিত ফলাফলে স্বাস্থ্য ক্যাডারে দ্বিতীয়স্থান অধিকারী ডা. ফরিদা বিনতে রহমান (ইমু) - ডক্টর টিভি

স্বাস্থ্য ক্যাডার মূল লক্ষ্য নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানই আমার পেশা এবং প্যাশন বলে জানালেন  ৪১তম বিসিএসের প্রকাশিত ফলাফলে স্বাস্থ্য ক্যাডারে দ্বিতীয়স্থান অধিকারী ডা. ফরিদা বিনতে রহমান (ইমু)। সম্প্রতি ডক্টর টিভিকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, অনেক মেডিকেল শিক্ষার্থী শুধুমাত্র অসচেতনতার জন্য বিসিএস জার্নি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। অনেকেই অহেতুক ভয় পান।

তাঁরমতে, মেডিকেলের একেকটা প্রফেশনাল পরীক্ষা যতটা শ্রম আর ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, বিসিএসে তার চাইতে অনেক কমই লাগে। তাছাড়া ডাক্তার, মেডিকেল স্টুডেন্ট এরা সবাই মেধাবী। সুতরাং সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় মেডিকেল স্টুডেন্টরা অল্প সময় ও অল্প শ্রমে বিসিএস এর পড়াশোনা অনেকখানি আয়ত্ব করতে পারবেন।

প্রসঙ্গত: চলতি মাসের ৩ আগস্ট ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রকাশিত ফলাফলে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন ও সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে ১৪০ জন চিকিৎসকসহ বিভিন্ন ক্যাডারে মোট ২৫২০ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।  

ডক্টর টিভির প্রতিবেদকের সঙ্গে স্বাস্থ্য ক্যাডারে দ্বিতীয় ডা. ফরিদা বিনতে রহমান (ইমু)’র সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলঃ

 

ফলাফলের পর অনুভূতিঃ

আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমার পরিশ্রমের মর্যাদা দিয়েছেন, রহমত করেছেন। এই চমৎকার  ফলাফল দেখে বার বার আব্বুর কথা মনে পড়ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। মেধাক্রমে দ্বিতীয় হবো- এটা কখনোই ভাবিনি। তবে ক্যাডারভুক্ত হবো, এতটা আত্মবিশ্বাস ছিল।

সাফল্যের কৌশলঃ

আমার মতে, বিসিএস একটা লম্বা জার্নি। ধৈর্য আর পরিশ্রমের চরম পরীক্ষা দিতে হবে- জেনেই এ রাস্তায় নেমেছি। যেহেতু দেশে থাকবো- সুতরাং বিসিএস ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই- এটা মাথায় গেঁথে নিয়েছিলাম। ইন্টার্নশিপের শুরু থেকেই মূলত প্রস্তুতি নেয়া শুরু। ফেইসবুক ও ইউটিউবের বিসিএস রিলেটেড গ্রুপে প্রচুর দরকারি পরামর্শ দেয়া থাকে। সেগুলো ঘেঁটে নিজের জন্য একটা দরকারি বুক লিস্ট করি। গাইড বই প্রথম থেকেই ভাল লাগতো না। সলিড একটা প্রিপারেশনের জন্য বিসয়ভিত্তিক বই কিনে পড়া শুরু করে দেই।

আমার জন্য সাফল্যের কৌশল একটাই- পড়াশোনা। কোন শর্টকাট ফলো করার অভ্যাস ছিল না কখনোই। ফলে পড়াশোনাতে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে। অবশ্যই অহেতুক পড়াশোনা নয়। পরীক্ষা অরিয়েন্টেড পড়াশোনা। সিলেবাস ধরে ধরে। ইম্পর্টেন্ট টপিকগুলো বের করা, নিজের উইক পয়েন্টগুলো চর্চার মাধ্যমে শক্তিশালী করা, স্ট্রং পয়েন্টগুলো আরও স্ট্রং করা, অভিজ্ঞ, সিনিয়র ও আমার বড় বোনের পরামর্শ নেয়া, সময় নষ্ট না করা এবং মাঝে মাঝে পরীক্ষা দেয়া। প্রিলির জন্য প্রচুর পড়ার অভ্যাস করা আর রিটেনের জন্য প্রচুর লেখার অভ্যাস করা। রিটেনের আগে পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যাচাই করা। বার বার রিভিশন দেয়া।
মেডিকেল শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র অসচেতনতার জন্য বিসিএস জার্নি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। অহেতুক ভয় পায়। মেডিকেলের একেকটা প্রফেশনাল পরীক্ষা যতটা শ্রম আর ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, বিসিএসে তার চাইতে অনেক কমই লাগে বলে আমার ধারণা। 

তাছাড়া ডাক্তার, মেডিকেল স্টুডেন্ট এরা সবাই মেধাবী। সুতরাং সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় মেডিকেল স্টুডেন্টরা অল্প সময় ও অল্প শ্রমে বিসিএস এর পড়াশোনা অনেকখানি আয়ত্ব করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো স্টুডেন্টদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা। যেমন :

১. বিসিএস এর প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব

২. এসব অংক, সাধারণ জ্ঞান আমাকে দিয়ে হবে না।

৩. অনেক পড়া, অনেক সময় লাগবে- এত ধৈর্য আমার নাই।

তবে যারা দেশেই থাকতে চান, সম্মানজনকভাবে আয় উপার্জন করতে চান, তারা তাদের প্রথম থেকেই বিসিএস এর প্রতি একটা পজিটিভ ধারণা রাখতে হবে। উগান্ডার রাজধানীর মুখস্ত করে কেউ আর ক্যাডার হয় না। এখানে মুখস্ত ক্ষমতা, অনুধাবন, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ অধ্যাবসায় আর ধৈর্য- সবকিছুর পরীক্ষা হয়।

এমবিবিএস পর পর বিসিএস না-কি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন?

এমবিবিএস এর পরও যদি ফ্যামিলি থেকে ফিন্যান্সিশিয়াল সাপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে  নিশ্চিন্তে বিসিএস বা পোস্টগ্রাজুয়েশন যেকোন একটি বেছে নেয়া যায়। কিন্তু আমরা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। সেদিক থেকে বলতে পারি, মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বিসিএস। যেহেতু দীর্ঘ জার্নি। তাই তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করা উচিত। এর মাঝে মাঝে পোস্টগ্রাজুয়েশেনের পড়া চাইলে পড়া যায়- যদি কেউ সময় এবং ফিন্যান্সিশয়াল সাপোর্ট ম্যানেজ করতে পারে।

এফসিপিএস বছরে ২বার এবং এমডি/এমএস বছরে ১বার দেয়া যায়। কিন্তু একটা বিসিএস এ অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়ার জন্য কতটা সময় অপেক্ষা করা লাগতে পারে- তা অনির্দিষ্ট। কেউ চাইলে ক্লিনিকে ২দিন ডিউটি করে বাকি ৫দিন বিসিএস এর জন্য পড়তে পারে।
তবে যাই পড়ুক না কেন- বিসিএস/পিজি শতভাগ ডেডিকেটলি পড়তে হবে। আমরা বেশিরভাগই বিসিএস/পিজি একসাথে চালাতে পারি না। তাই আমার মতে, মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বিসিএস।

বিসিএস- রিজিক, সম্মান, মাস শেষে সম্মানজনক স্যালারি নিশ্চিত করতে পারলে,পরবর্তীতে সুস্থ মস্তিষ্কে পোস্টগ্রাজুয়েশনের পড়াশোনা করা যায়।

জেনে শুনে অবহেলিত স্বাস্থ্য ক্যাডারে!

স্বাস্থ্য ক্যাডার হওয়া তো জীবনের লক্ষ্য নয় মোটেই। আলহামদুলিল্লাহ! ডাক্তার হয়ে আব্বু-আম্মু সবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। এখন দেশে থেকে ডাক্তারী করার জন্য স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করা ছাড়া অন্যকোন উপায় আছে? তবে, সারাদিন স্যার, স্যার শোনা, অর্থ- ক্ষমতা মোহ থাকলে অন্য কোন ক্যাডার পছন্দ করতাম। যাদের এসবের মোহ আছে, তারা ফরেন, অ্যাডমিন বা পুলিশ ক্যাডারে যাচ্ছেন। এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।

চলার পথে ফ্যামিলি সাপোর্টঃ 

অন্য সবার চাইতে আমি নিজেকে একটু বেশিই ভাগ্যবান মনে করি। কারণ মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ফ্যামিলির পরিপূর্ণ সাপোর্ট পেয়েছিলাম। দুয়েকবার ক্লিনিকে ডিউটি করতে গিয়ে যে পরিবেশ দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল, এভাবে কাজ করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। বাসায় বলেছিলাম, আমাকে এতদিন যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছো, আর কিছুদিন সেভাবেই সাপোর্ট দাও।

আব্বু বলেছিলেন, আমার যত কষ্টই হোক তোমার পড়াশোনা নষ্ট করে চাকরি করতে হবে না। আমার বড়ু আপু একটা কলেজের প্রভাষক, তাঁর কাছ থেকেও অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, স্বল্পতম সময় ৪২ত বিসিএস এ নিয়োগপ্রাপ্ত হই। এরপর থেকে বড় বোনের পাশাপাশি আমিও পরিবারের হাল ধরতে সমর্থ হই। তাদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে সমর্থ হই। আজ আমার আব্বু আর বেঁচে নেই। তবে তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন তাঁর মেয়ে বিসিএস ক্যাডার। আমার তাই আর নতুন করে কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই, আলহামদুলিল্লাহ।

আরেকজনের কথা না বললেই নয়, সে আমার হাজবেন্ড ফারহান। ৪১ তম বিসিএসের রিটেন এবং ভাইভার আগে প্রিপারেশন, টেকনিক, নিয়মিত পড়াশোনা এসব ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছিল এবং এই "দ্বিতীয়" হওয়ার পিছনে তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না।
সর্বোপরি, আমার আব্বু আম্মু, আমার বোনসহ কাছের সব মানুষের দোয়া আর সহযোগিতায় আমার আজকের এই অর্জন।

 

চিকিৎসা পেশায় আদর্শঃ

নির্দিষ্ট করে কাউকে আদর্শ মানি না। তবে, সবার কাছ থেকেই ভাল কিছু নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি। আমার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের অনেক টিচার, যাদের অধীনে আমি মিটফোর্ড হাসপাতালে ট্রেইনিং করেছি এবং এখন করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের সবার কাছ থেকে একটু একটু করে ভালগুণ নিজের মধ্যে জমানোর চেষ্টা করছি।

ভবিষ্যত পরিকল্পনাঃ

রেসপিরেটরি ট্রেইনিং শেষ করে এমডি ডিগ্রি অর্জন করা। Honesty & Efficiency’র মাধ্যমে মেডিকেল প্র্যাকটিস করা। সরকারি চাকুরির পদায়ন যেখানেই হোক না কেন, সেখানে আমার যোগ্যতা ও নিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখা। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া। যাতে অন্ততঃ রোগীরা আমাকে দেখে বলতে পারে- যত যাই হোক, অন্ততঃ অমুক ডাক্তারের ব্যবহার ভাল।

ব্যক্তিগত জীবন, সংসার ও ক্যারিয়ারের মধ্যে ব্যালান্স রাখার চেষ্টা করা। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগ দান।


জন্ম ও বেড়ে ওঠাঃ

কর্ণফুলী নদীর তীরে জেগে থাকা ছবির মত সুন্দর কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায় আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। কর্ণফুলী শিশু বিদ্যালয় থেকে প্রাইমারী এবং কর্ণফুলী পেপার মিলস হাইস্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিকের পড়ালেখা শেষ করি। এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রামে নবম স্থান অধিকার করে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সুযোগ পাই।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসিতে মেয়েদের মধ্যে বোর্ডে প্রথমস্থান অধিকার করি। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় ৩৫৭তম হয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। ২০২০ সালে ইন্টার্নশিপ শেষ করেই ৪২তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এতে ১১তম স্থান অর্জন করি। পরবর্তীতে রাঙামাটির কাউখালি উপজেলায় একবছর মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকি। ২০২২ এর ডিসেম্বরে বিএসএমএমইউর অধীনে রেসিডেন্সি পরীক্ষায় পালমোনলজি/রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিটিতে প্রথমস্থান অধিকার করে বিএসএমএমইউতে ট্রেইনিং করার সুযোগ পাই। বর্তমানে এখানেই আছি ডেপুটেশনে।



ইভেন্ট স্ট্রিম : বিসিএস পরীক্ষা