জীবন যেখানে যেমন

মানুষের পরিচয় টাকায় না, তার আচরণে হোক

জীবন যেখানে যেমন

মানুষের পরিচয় টাকায় না, তার আচরণে হোক

রোগীর সমস্যা
মানুষের পরিচয় টাকায় না, তার আচরণে হোক - প্রতীকী ছবি

৩ সপ্তাহ আগে ৩০ বছরের একজন নারীকে দুজন মিলে ধরাধরি করেন আনলেন আমার চেম্বারে। রোগীর সমস্যা শুনছিলাম। ভদ্রমহিলার স্বামী যা বললেন তার সারমর্ম হলো, তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা। শুরুতে চাকরি ভালই চলছিলো। স্বামীর বাড়ির পাশে একটা স্কুলে চাকরি করত। ২ সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছিল।

হঠাৎ করে ভদ্রমহিলার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। তিনি চাকরি করবেন না। একবার রিজাইন লেটার দিয়েছিলেন। কিন্তু রিজাইন লেটার (পদত্যাগপত্র) তাদের পরিবারের এক সুহৃদের হাতে পড়ায় তিনি মেয়ের বাবাকে জানান। মেয়ের বাবা চেয়ারম্যান ছিলেন অনেকদিন। চেয়ারম্যান সাহেব দ্রুত রিজাইন লেটার তুলে নেন। পরে বাবার বাড়ির পাশের এক স্কুলে পোস্টিং করানো হয়। বছরখানেক ধরে ভদ্রমহিলা স্কুলে যান না।

করোনা তাকে সাহায্য করেছে। এখন করোনার পর স্কুল খুলেছে স্কুলে তো যেতে হবে। কিন্তু ভদ্রমহিলা হাঁটতে পারছেন না। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। মাথা নিচের দিকে বেঁকে গেছে ওপরে তুলতে পারছেন না। কথা স্পষ্ট না একেবারেই। এ অবস্থায় স্কুলে গেলে তো সমস্যা। কেউ স্কুল ভিজিটে আসলে তো চাকরি থাকবে না। তার ওপর ভদ্রমহিলা চাকরি করতে চান না।

আমার খুব কষ্ট হলো। শিক্ষকতা পেশার লোকদের আমি খুব সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। ভদ্রমহিলার আগের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখলাম। আমার মনে হলো উনি ওষুধ সেবন সংক্রান্ত এক্সট্রা পিরামিডাল সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। কিছু চিকিৎসা দিয়ে অবজার্ভ করার জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে বললাম।

ঘন্টাখানেক পর ভদ্রমহিলাকে ধরে ধরে আনলেন তার বাবা ও পড়শি এক চাচা।

 

আমি চিকিৎসা দিচ্ছি। এমন সময় চেয়ারম্যান সাহেব ফোনে চিৎকার করছেন। স্বামীকে ফোন দিয়ে বলছেন, ‘বলদের বাচ্চা বলদ, জানোয়ার কই তুমি? নিচে কী করছ? ডাক্তারের রুমে আসো।’

আরো কিছু বাজে শব্দ ব্যবহার করলেন।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। স্বামী বেচারা ওপাশ থেকে বলছেন, আব্বা ২ মিনিট লাগবে। আমি এসে পড়েছি। কিন্তু চেয়ারম্যানের মুখ থামছেই না। কেন যেন আমার বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে গেলো।

আমি ও সময়ই সিদ্ধান্ত নেই চেয়ারম্যান সাহেবকে জামাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু শিক্ষা দিবো। কিন্তু আজকে সে সময় না।

২ সপ্তাহ পর আসতে বললাম। তারা গেল শুক্রবার আসলেন। সাথে সেই তিনজন।

চেয়ারম্যান সাহেবের মুখে হাসি দেখে রোগীর অবস্থা বুঝলাম। আলহামদুলিল্লাহ ভদ্রমহিলা এখন অনেকটা সুস্থ। লাল আর ঝরে না, ঘাড় সোজা হয়েছে। কথাও বলছে বেশ স্পষ্ট করে। আমার প্রতি সবাই খুব খুশি। এবার আমার প্ল্যান বাস্তবায়নের পালা।

স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, খুব চাপে আছেন না। চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিয়ে করতে গেলেন কেনো?

স্বামী বেচারা খুব ভদ্র। কিছু না বলে হাসলেন। এ হাসির অর্থ আমি জানি। বুক ফাটা হাসি যাকে বলে।

স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম কী করেন?

তিনি কিছু বলার আগে পড়শি চাচা বললেন, টো টো কোম্পানিতে ম্যানেজারি করে।

শুনেও না শোনার ভান করে বললাম, কী বললেন?

তিনি কিছু বলার আগে স্বামী হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, তিনি আগে ঢাকায় একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ভালো স্যালারি ছিলো। কিন্তু স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করছেন। স্বামীর জন্য সত্যি আমার চোখে পানি চলে আসলো।

এবার সেই পড়শি চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি কি করেন?

দাঁত বের করে বললেন, বিদেশে ছিলাম। এখন কিছু নাই বাবা।

আমি বললাম, স্বামী বেচারা চাকরিতে গেলে আপনি ওনার ছেলেমেয়েদের দেখতে পারবেন না?

উনি বললেন, আমি কিভাবে পারব?

আমি বললাম, তাহলে ওনাকে নিয়ে বাজে কথা বললেন যে। বেচারা কাচুমাচু করছেন।

চেয়ারম্যানের দিকে ফিরে বললাম, জামাইয়ের সাথে খারাপ আচরণ করতে খারাপ লাগে না। আপনার তো উচিত জামাইয়ের পায়ে ধোয়া পানি খাওয়া। অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে সংসার করছে। অন্য কেউ হলে তো ছেড়ে চলে যেত। নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে রান্না করে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে। আপনারা নাম দিয়েছেন টো টো কোম্পানির ম্যানেজার। উনি তো গেলেই চাকরি পাবেন। চাকরিতে গেলে আপনার মেয়েকে দেখবে কে? অসুস্থ মেয়েকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে জামাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে কেন অভদ্রতার পরিচয় দেন।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ ছলছল করছে। আমি কেন যেন প্রশান্তি পেলাম।

চেয়ারম্যান ও পড়শি চাচার মত লোকদের আমি চিনি। সেই সাথে চিনি ভদ্র জামাইকে। জামাই ভদ্র বলে ওরা সবাই মিলে যা ইচ্ছে তাই করে। বেচারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। ফলে সে হয়েছে জাতীয় সম্পদ। যে যেভাবে পারে অপমান অপদস্থ করে। তাকে চাকরিও করতে দিবে না আবার অপমান করাও থামাবে না।

চেয়ারম্যান ও পড়শি চাচার মত লোকেরা মানুষকে মুল্যায়ন করে টাকা দিয়ে। এরা টাকা আছে জন্য ঘুষখোর, মাদক বিক্রেতা, ব্যাংক ডাকাতদের সম্মান করে। কিন্তু ভদ্র, সৎ মানুষগুলোকে টাকা না থাকলে চরম অপমান করে। কথায় কথায় অপদস্থ করে।

আমি এ ধরণের মানুষদের চরম ঘৃণা করি। এদের পশু থেকে কিছুটা উন্নত মনে করি। তাদের সাথে কথা বলতে আমার বমি আসে।

মানুষের পরিচয় টাকায় না, তার আচরণে হোক।