মেডিকেল পড়াশোনায় ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং (পর্ব-২)

ডা. সেরাজুস সালেকিন

সহকারী অধ্যাপক, থোরাসিক সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মেডিকেল পড়াশোনায় ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং (পর্ব-২)

মেডিকেল পড়াশোনা
মেডিকেল পড়াশোনায় ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং - ফাইল ছবি

সামনেই আছে রেসিডেন্সি পরীক্ষা। কেউ কেউ নিশ্চিতভাবে মনস্থির করে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তেমনি আবার কেউ কেউ তেমন না বুঝেই কিছু বিষয় নিয়ে পড়ার জন্য ভাবছে।

আমি আমার আগের লেখায় বলেছিলাম, আমার দেখা কিছু শিক্ষার্থী আছে, যারা না জেনে-বুঝে পোস্ট গ্রাজুয়েটের বিষয় নিয়ে পড়ছে আর আক্ষেপ করছে। এই ঘটনা আমার নিজের বিষয় অর্থাৎ কার্ডিও-থোরাসিক এবং ভাস্কুলার সার্জারি (Cardio Thoracic and Vascular surgery) নিয়েও আছে।

আমি কিছু শিক্ষার্থীদের জানি, যারা নিতান্তই অনিচ্ছা নিয়ে এই বিষয় পড়ছে বা এই বিষয়ে পড়া শুরু করার পর হতাশায় ভুগছে। তাই বিষয় নির্বাচনের আগে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

আমি চেষ্টা করবো আমার পোস্টে এই সাবজেক্ট নিয়ে কিছু বলার। তিন ভাগে আমি (হৃদযন্ত্র, বক্ষ, ভাস্কুলার) নিয়ে লিখবো। যদি এটার দ্বারা কোনো ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের উপকার হয় তবে ভালো লাগবে।

হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার

মূলত হার্টের অপারেশন করা হয়। বাইপাস সার্জারি, ভালভ সার্জারি, ASD, VSD, Tetralogy of Fallot সহ আরও কিছু অপারেশন করা হয়। এ দেশ কার্ডিয়াক সার্জারি করে রোগী সুস্থ হওয়ার ফলাফল অনেক ভালো, খরচও কম। বর্তমানে minimal invasive cardiac surgery দ্বারা ও চিকিৎসা করা হচ্ছে।

কোর্স

বর্তমানে সকল MS ও MD রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের অধীন। এটা Cardiovascular and thoracic surgery নামে। মূলত NICVD, BSMMU, National heart foundation চালু আছে। মেয়াদ পাঁচ বছর।

এছাড়া এফসিপিএস ডিগ্রি আছে cardiac Surgery নামে। সরকারি চিকিৎসক প্রেষণে আর বেসরকারি চিকিৎসক মাসিক ভাতা পাবেন। পাশের হার তুলনামূলক ভালো।

এরই মাঝে বেশ কিছু কার্ডিয়াক সার্জন পাস করার পর এমআরসিএস দিয়ে ইউকে-তে ট্রেনিং পোস্ট নিয়ে FRCS সম্পন্ন করেছেন, কেউ কেউ করছেন। তারা সেখানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট unit চালান, কেউ হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট-এ কাজ করেন।

মাস্টার্স করে amc করে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে পরবর্তী পড়াশোনা করা যায়। যদিও এটা আরও দুঃসাধ্য।

কেউ কেউ বিদেশে বিভিন্ন ট্রেনিং নিতেও জান। কাজের পরিধি, ক্ষেত্র বা ভবিষ্যতে সরকারি চিকিৎসক NICVD, ঢাকা মেডিকেল কলেজের এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে কাজ করতে পারবেন। আর বেসরকারি পর্যায়ে হার্ট ফাউন্ডেশন, বারডেম, ইউনাইটেড হাসপাতালে; এছাড়া আরও কিছু হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ এ কাজ করতে পারবেন।

বর্তমানে দেশে প্রায় তিনশ’ পাস করা কার্ডিয়াক সার্জন আছেন। যদিও ইন্ডিপেডেন্ট সার্জন হাতেগোনা তিরিশের মতো। বাকিরা অনেকেই কার্ডিয়াক সার্জারি অপারেশনে অ্যাসিস্ট, পোস্ট অপারেটিভ আইসিইউ- এসব নিয়ে কাজ করেন। কেউ কেউ পাস করে বিভিন্ন জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে যুক্ত হয়ে জেনারেল সার্জারিতে আছেন।

সিএমএইচ, ঢাকাতে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ চালু আছে। যদিও সেখানে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পাবেন।

সার্জারির অন্যান্য ব্রাঞ্চ থেকে এর পটভূমি ভিন্ন। পাস করেই যেকোন হাসপাতালে এই অপারেশন কোনোভাবেই সম্ভব না।

 কারণগুলো হলো

১. কার্ডিয়াক সার্জারি করতে গেলে যেসব যন্ত্র মেশিন দরকার আর পোস্ট অপারেটিভ যে ধরনের সেট আপ দরকার সেটা অনেক জায়গাতেই নেই।

২. শুধু যন্ত্র বা মেশিন না, এই অপারেশন করতে দরকার দক্ষ অবেদনবিদ (এসব অপারেশনে per operative post operative ক্ষেত্রে অবেদনবিদের অনেক বড় ভূমিকা আছে) দক্ষ নার্স, ইনটেনসিভ কেয়ারের জন্য লোক।

৩. অন্যান্য সার্জারি থেকে এসব সার্জারি ব্যয়বহুল।

৪. এটা একটা টিম ওয়ার্ক। মূল সার্জন দক্ষ হলেই হবে না, তার টিম মেম্বারের সকল ডাক্তার, নার্স, এনেসথেসিয়া ডাক্তার পেরফৌশনিস্ট সবাইকে খুব ভালো রকম synchronized হতে হবে। এটা একটা আক্ষরিক অর্থেই মহাযজ্ঞ।

৫. বাস্তবতা এটাও যে রোগী তার হার্টের অপারেশন করাতে গিয়ে সব সময় সিনিয়র সার্জন খোঁজে। জুনিয়র সার্জন দক্ষ হলেও তারা খুব সহজেই তাদের কাছে অপারেশন করাতে রাজি হন না।

৬. এই সাবজেক্টের প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে সার্জন মূলত সেকেন্ডারি ফিজিশিয়ান। তার কাছে রোগী সরাসরি আসার সম্ভাবনা কম। একজন cardiologist রেফার না করলে রোগী নিজ উদ্যোগে সার্জন এর কাছে আসেন না।

এই সার্জারির দক্ষতা অর্জন করতে হলে একজন সার্জনকে কোর্সে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে পাস করে আরও পাঁচ-সাত বছর ২৪/৭ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। হাতের কাজ দেখা ও শেখা, পোস্ট অপারেটিভ আইসিইউ দক্ষতা অর্জন এসব সময় সাপেক্ষ। যদিও রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের আওতায় এ সব কিছুই ট্রেনিং পিরিয়ডে রপ্ত করার কথা। কিন্তু পাঁচ বছরেই এটা অর্জন কিছুটা দুঃসাধ্য। আর এই বিষয় এ বিশেষজ্ঞ হওয়ার পর আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে অর্থভাগ্য একেক জনের একেক রকম।

এরপরেও এই বিষয়ে কাজ করার একটা ভিন্ন আনন্দ, ভালোলাগা কাজ করে। এটা আর অন্যান্য সার্জারি থেকে ভিন্নমাত্রার এবং চ্যালেঞ্জিং। ভালো দিক, মন্দ দিক দুটোই মিলিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পরিশ্রম করার আর দীর্ঘ সময় ধরে সার্জারি করার মন-মানসিকতা থাকলেই কেবল এই বিষয় নিয়ে পড়া উচিত।

রিলেটেড সংবাদ


আরও দেখুন: