কিংবদন্তি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর জীবনের গল্প

কিংবদন্তি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর জীবনের গল্প

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
দেশের কিংবদন্তি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ - ছবি: সংগৃহীত

দেশের কিংবদন্তি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম সেরা এ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বর্তমানে সচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর প্রধান চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।  শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের সবুজ-শ্যামল পরিবেশে। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় তিনি খুব সহজেই শিক্ষকদের নজর কাড়তে পেরেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছেন তার জীবনের গল্প।

জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলায় গ্রামের নাম হালিয়াবাড়ি। ছোট্ট একটা পাড়াগ্রামের ছেলে। তার খেলার সাথীও সীমিত ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যাও ছিল সীমিত।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান।

প্রাথমিক পাস করে গ্রামেই ইসলামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বরাবরই তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। সবসময়ই তার শিক্ষকদের নজরে থাকতেন। সেখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ম্যাট্রিকে ভালো ফলাফল করায় নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করেন।

মাধ্যমিক শেষে সবাই চেয়েছে জামালপুর আরশিমহত কলেজে যেন তিনি ভর্তি হয়। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল দেশের নামকরা কোন কলেজে ভর্তি হবেন। এজন্য তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা কলেজে ভর্তি হন।

চিকিৎসক হওয়ার গল্প

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ জানান, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে তার ইচ্ছা ছিল বড় কোনো অফিসার হবেন। তখন পাকিস্তানি সরকারের সময় সবথেকে বড় আকর্ষণীয় পদ ছিল সিএসপি। এটি টার্গেট করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। তবে তার বাবা-মা’র ইচ্ছা ছিল ছেলে যেন ডাক্তার হয়। তাদের ধারণা ছিল, ছেলে অফিসার হলে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ কম হবে। আর ডাক্তার হতে পারলে সব শ্রেণির মানুষের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। তাই অন্যকিছু না ভেবে তিনি ভাবলেন যে ডাক্তারই হবেন।

ইন্টারমিডিয়েট পাস করে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেলেন। এখানেও ভালো ফলাফল নিয়ে তিনি এমবিবিএস পাশ করলেন। ঢাকা মেডিকেলে তিনি ১৯৭২ সালে ভর্তি হন এবং ১৯৭৮ সালে এমবিবিএস পাস করেন। মেডিকেল সায়েন্সে পড়াশোনা প্রচুর হউয়ায় অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ কম পেয়েছেন। সুযোগ পেলে তিনি মাঝে মধ্যে ইনডোরে খেলাধুলা করতেন।

এমবিবিএস পাস করে এবিএম আব্দুল্লাহ মনে করলেন এটাও পর্যাপ্ত নয়। এজন্য তার বড় ডিগ্রি প্রয়োজন। তাই তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েট করতে চান। তিনি গ্রামে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর তিনি সহকারি রেজিস্ট্রার পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। এখানেই তার কর্মজীবনের শুরু।

প্রায় ৪ বছর চাকরির পরে তার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আসে। তার স্বপ্ন ছিল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়ার। তাই তিনি সেখানে চাকরি ছেড়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৮৯ সালের শেষে ব্রিটেনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি ব্রিটেনে মেডিসিনের সবথেকে বড় ডিগ্রি সিপি অর্জন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডে বেশি সময় কাটান। লন্ডনেও কিছু সময় কাটিয়েছেন। তার মূল টার্গেট ছিল ডিগ্রি অর্জন করা। তাই সেখানে তার সময় কাটে পড়াশোনা আর হাতে-কলমে কাজ শিখে এবং পরীক্ষার ফলাফলও ভালো হয়।

দেশপ্রেমের কারণে বিদেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে পিজি হাসপাতালে

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ  উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পান। তখন তিনি চিন্তা করলেন, শুধু বিদেশেই পয়সা অর্জন করলে তার হবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশেই ফিরে আসবেন। দেশের মানুষের সেবা করবেন। তার যে ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা রয়েছে তা দিয়ে দেশের মানুষকেই সেবা দেবেন। তিনি ১৯৯২ সালে দেশে এসে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেডিসিন কনসালট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পান। তিনি সেখানে দুইবছর কাটান।

এরপর তিনি ১৯৯৫ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারি অধ্যাপক পদে তিনি তৎকালীন পিজি (বর্তমানে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে যোগদান করেন। পরবর্তীতে এর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) দেওয়া হয়। এখানেই তিনি অধ্যাপক হলেন। তিনি পরপর তিনবার বিএসএমএমইউতে নির্বাচিত ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আর কোথাও বদলি হয়নি।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য বই লেখার গল্প

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এবার মনে করলেন তার শিক্ষার্থীরাই তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করছেন। তিনি ভাবলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে তার জ্ঞান কিভাবে জানানো যায়। তাই তিনি বই লেখা শুরু করলেন। এখন পর্যন্ত তিনি ছয়টি বই লিখেছেন। তার বই এখন দেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বইগুলো তিনি দেশের পাবলিকেশনে পাবলিশ করতেন।

দেশের বাইরের দুটি পাবলিশার থেকে তার বই পাবলিশ করা হয়। একটি ‘এলসিবিআর’ ব্রিটিশ জার্মান পাবলিশার। আরেকটি ভারতীয় পাবলিশার ‘জিপি ব্রাদার্স’। এলসিবিআর দুটি বই আর জিপি ব্রাদার্স তার চারটি বই পাবলিস করে। তার ছয়টি বই দিল্লি থেকে পাবলিশ করা হয়। তার সব বই মেডিকেল কারিকুলামে করা। বইগুলো ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এগুলোর বাইরেও ব্রিটেনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন যারা করছেন তারা পড়ে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাতেও তার বইগুলো চলে। এটা তার অনেক বড় প্রাপ্তি।

চিকিৎসক হিসেবে প্রাপ্তি

ব্যক্তিগত জীবনে তার কোনো অপূর্ণতা নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। চিকিৎসাখাতে তার অসামান্য অবদানের জন্য একুশে পদকসহ তিনি এ পর্যন্ত অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

তিনি ‘শর্ট কেইস অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’ বইয়ের জন্য তিনি ২০১৩ সালে ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন’ অ্যাওয়ার্ড পান। ওই সময়ে সেরা বই হিসেবে তিনি এই স্বীকৃতি পান। এরপর তিনি ২০১৬ সালে ‘একুশে পদক’ পান। বাংলা একাডেমি থেকে তাকে ওনারি ফেলোশিপ দেওয়া হয়।

সাফল্যের চাবিকাঠি

ক্লাসে সবসময় প্রথম হওয়ায় তিনি শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মনে করেন তার এতদূর আসার পেছনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক ছিল। তার এ পর্যন্ত আসার পেছনে তার বাবা-মা ও  ব্যাপক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। একই সঙ্গে তার সহধর্মিনী ও সন্তানদের ত্যাগ ও উৎসাহ ছিল বলে দেশের কিংবদন্তি এ চিকিৎসক। তিনি ১৯৮১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। (এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাস পরবর্তী শারীরিক জটিলতা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী অধ্যাপক মাহমুদা বেগম মৃত্যুবরণ করেন।)





আরওঃ   বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়