দামতুয়া ঝর্ণায় ১১জন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় চিকিৎসক

ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা

মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন কার্যালয়, খুলনা

দামতুয়া ঝর্ণায় ১১জন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় চিকিৎসক

ভ্রমণ কাহিনী
ওরা ১১ জন - শেখ সাদিয়া

মাত্র একটি দিন পৃথিবী থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিল ওরা ১১ জন।  পৃথিবীর বাইরে কোন স্বর্গ রাজ্যে। এটা চেম্বার, ডিউটি এবং কাজ ছাড়া নিজেদের ভাবতে না পারা ভীষণ সৌখিন ছাপোষা চিকিৎসকের স্বর্গযাত্রার কাহিনী!

আমার শত জনমের ভাগ্য এই ১১ জনের একজন আমি । হাতে যদি একটু সময় থাকে পড়ে আসতে পারেন পাগলামিতে ভরা আমাদের একটি দিনের গল্প।


ভোর চারটায় ভূমিকম্প দিয়ে বান্দরবানের আলীকদম থেকে যাত্রার শুভ সূচনা। ঘুম ঘুম ভোরে সবার প্রথম গন্তব্য ‘১৭ কিলোমিটার’।

মখমলের মতো সবুজ পাহাড়ের বুকের উপর সাপের মত প্যাঁচানো আঁকাবাঁকা পথ। তার উপর দিয়ে চাঁদের গাড়ি যখন আমাদের সবার চোখের ঘুম উড়িয়ে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলছে, তখনও মেঘের ঘুম ভাঙেনি। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে পরম নির্ভরতায় আকাশ ঘুমিয়ে আছে। সম্ভবত ভোর বেলায় ভূমিকম্পে সে কিছুটা বিরক্ত! ঘুমিয়ে ছিল ভালই ছিল। হঠাৎ জেগে উঠলো। ঘুমিয়ে থাকার জন্য বোধহয় কোন কাজ পিছিয়ে গেছে। সে কাজের চাপ সইতে না পেরে কান্নাকাটি শুরু। আর ১ ঘন্টা পিছিয়ে পড়লাম!

আমার মেডিকেলের সিনিয়র ভাই এবং সিনিয়র বিসিএস পঙ্কজ ভাই । তিনি আবহাওয়াবিদ এর ভূমিকায় চলে গেলেন এই অবস্থায় ট্রাকিং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটি জাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আসলেই স্যাঁতসেঁতে এবং পিচ্ছিল হয়ে যাবে খাড়া পাহাড়, আমাদের প্রথম ট্রেকিং ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু কোন লাভ হলো না। আমাদের সবার শরীরে পাগলামির যে অ্যান্টিজেন ঢুকে গেছে তার কোন অ্যান্টিবডি নেই।

বৃষ্টি শেষ হলো, শুরু হলো ট্রেকিং। যাত্রীদের বেশিরভাগেরই জীবনে এটি প্রথম ট্রেকিং। যেখানে যাওয়া হচ্ছে সেই বিষয়েও খুব একটা আইডিয়া ছিল না। হাতুড়ে ডাক্তার যেমন না জেনে অবলীলায় ফোঁড়া অপারেশন করতে পারেন, তেমনি আজকের এই দল 'হাতুড়ে ট্রেকার'।

স্বভাবতই যে সময় পৌঁছানোর কথা তার থেকে একটু সময় বেশিই লাগলো। পৌঁছানো থেকে নিরাপদে পৌঁছনো ছিল এই হাতুড়ে ট্রেকারদের মূল লক্ষ্য। ট্রেকিংয়ে অবলীলায় হেঁটে গেছে ডা. সুদীপ্ত, ডা. নীপা, ডা. মুকিত। নিপা মোটামুটি দেশের সব জায়গাতেই গিয়েছে। সম্ভবত এইমাত্র যদি নতুন কোন ঝর্ণা আবিষ্কার হয় সে সেখানেও যাবে। এও হতে পারে, নিপা নিজেই কোন জায়গা আবিষ্কার করেছে। 'তাহার বন্ধু' সুদীপ্ত যাকে আমার খুব ঠান্ডা বলে মনে হয়েছিল, সে খুলনার চুইঝাল। এর আগে সে মৌলভীবাজারের ‘হামহাম’ গেছে। তার ভাষ্যমতে এই ট্রেকিং হামহামের মত জায়গার কাছে কিছুই না। আর মুকিত ভাই গিয়েছেন ‘জাদিপাই’।


আমাদের মধ্যে সবথেকে সিনিয়র কিন্তু ’শিশু’ প্রসেনজিৎ ভাই (শিশু ডাক্তার), যতক্ষণ পেরেছেন প্রত্যেককে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। বরগুনার mocs মেহেদী যতক্ষণ পেরেছে গানে গানে ভরিয়ে রেখেছে। যার কথা না বললেই নয় আমাদের উখিয়ার রাজকুমার ‘লিডার অফ দা ডে’ ইমরান ভাই।যখনই অভিযাত্রী দল ঝিমিয়ে বা পিছিয়ে পড়েছে তখনই তিনি গর্জে উঠেছেন তার অমর বাণী নিয়ে ‘Guys ! Hold your Heart...’

সমগ্র যাত্রায় এই দৈব বাণী টনিকের মত কাজ করেছে! আমি আর আলামিন ভাই বৃষ্টি জড়ানো কাঁদা পথে কয়েকবার ডিগবাজি খেয়েছি। আসলে আমরা কিন্তু ইচ্ছা করেই খাচ্ছিলাম। আমরা ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিলাম আর কি!!
সম্ভবত প্রথম দিকে তিনটি পাহাড় অতঃপর কিছুটা সমতল জায়গা। তারপর একটি বেশ ভাল রকমের খাড়া পাহাড় পার হতে হয়েছিল আমাদের। এক একটা পাহাড় সম্পূর্ণটা সবুজ দিয়ে মোড়ানো, তাতে দূর থেকে ছোট ছোট আদিবাসীদের ঘর দেখা যায়। যেন বাইরের কেউ বেশি বিরক্ত না করে তাই মেঘ তার মেঘমালা দিয়ে পাহাড়কে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে।
বহিরাগতের অনুপ্রবেশ নিষেধ!
মনে হয় থেকে যাই এখানে সারা জীবনের জন্য...


যত গভীর মনে প্রবেশ করেছি ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঝিরির পরিমাণ। রীতিমতো সুগন্ধ সুরঙ্গ ভাব। দুপুর বারোটাতেও এতটুকু আলো কোনভাবে পৌঁছায়নি সেখানে। আমাজান জঙ্গলের মত। উপরে খাড়া পাহাড় নিচে ঝিরি। যে পথগুলো ঝিরির মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেগুলো একই সাথে খুব আরামের ও বিপদ সংকুল। কারণ ঠান্ডা পানি যখনই পায়ে লাগে তখনই ভালো লাগে । হাঁটার পথে কষ্টটা ঠান্ডা পানিতে কিছুটা প্রশমিত হয়। আর বিপদ সংকুল হলো কতটা নিচে পা দিতে হবে এটা বোঝা যায় না। এক একটা পাথরের উচ্চতা এক এক রকম।
লাঠি দিয়ে পথ মেপে মেপে যেতে হয়।

’দামতোয়া’ মূল ঝর্ণার আগে ’ব্যাং ঝর্ণা’ বলে একটি ঝর্ণা আছে। এখানে আসার পরে আমি একটু প্রাণ ফিরে পাই। এরপর লাফাতে লাফাতে সবার প্রথমে ঝরণায় পৌঁছালাম।


সম্ভবত আমি আমার জীবনে এর বেশি জোরে হর্ষধ্বনি করিনি। বিষ্ময়ে বিমুর হতবাক হয়ে গেলাম একসাথে দুই তিনটা ঝরনা দেখে। বৃষ্টি হওয়ার দরুন পানির উচ্চতা যেমন বেড়েছে তেমনি পানির রঙেও এসেছে গাঢ়ত্ব।

সমস্ত কষ্ট ভুলে গেলাম!
ভুলে গেলাম আবারও হয়তো তিন ঘন্টা যাত্রা করে ফিরে যেতে হবে! ভুলে গেলাম সময় মতো আজকেই বিয়াম এ ১০টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। আগামী কাল সকাল ৫টায় পিটি সেশন!

ভুলে যেতে চাইলাম জীবনের সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা! শুধু মনে হলো,আমাদের ১১ জনের জীবনের হয়তো একসাথে এই সময়টা আর আসবেনা। বৃষ্টি পরবর্তী খরস্রোতা শীতল জলে ভাসিয়ে দিলাম মন পাবনের নাও। পৃথিবীর কোন শব্দ প্রযোজ্য নয় এই মুহূর্তের বর্ণনা দেবার জন্য। বিশাল জলের প্রবল স্রোতের সামনে আবারও মনে পড়ে গেল আমিত্ব কত ক্ষুদ্র একটি শব্দ।


কতক্ষণ ছিলাম এভাবে জলে ডুবে ডুবে মনে নেই।
কিভাবে মনে থাকবে? সময় তো আমি আজ অনেক আগেই থামিয়ে দিয়েছি। হাতের স্মার্ট ওয়াচ বলছিল pulse কোনভাবেই ১২০ এর নিচে নয়।
কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে অনুরণিত হচ্ছিল Its ok...
ফেরার পথে উঠতে গিয়ে ভয়ংকর muscle cramp ..
প্রথমে বসে পরলেন গোপালগঞ্জের mocs সাকিব ভাই, ইমরান ভাইয়ের কিঞ্চিত ’স্পা’ তাকে দ্রুত সুস্থ করে দিলেও পরপর উইকেট পড়তে লাগলো প্রসেনজিৎ ভাই আলামিন ভাই এবং আমার। আসলে ঝর্ণায় প্রচুর আনন্দ করার পর শরীর ছেড়ে দিয়েছিল।এদিকে আবার কেউ কাউকে না নিয়ে আগাবে না।প্রচন্ড একটা টিমওয়ার্ক কাজ করছিল আমাদের সকলের ভিতরে।


জীবনে এত স্যালাইন ডায়রিয়া হলেও খাইনি। একটু সুস্থ লাগছিল। পথে পেয়েছিলাম লোকোজ বাতাবি লেবু।
৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর আবার রওনা দিলাম।
আমাদের গাইড মোঃ নুরুল ইসলাম রাজুর কথা না বললেই নয়। যেভাবে ও সাপোর্ট দিয়েছে পুরোটা সময়, সুন্দরবনে আমি ওর গাইড হব এই প্রমিস করে এসেছি।
প্যারাসিলিং করে আমার হার্টের ব্লক ছুটে গেছিল বলে মনে হয়েছিল, ট্রাকিং করে পেরিফেরাল হার্ট অর্থাৎ পায়ের muscle এ কোন ব্লক থাকলে আজ ছুটে গেছে বলে মনে করছি।


দুর্গম এলাকায় রাখাইনদের জীবনযাত্রা, ক্ষেতে কাজ করা নারীদের কানে বিশেষ ধরনের কানের দুল, নাচান ঘরের ছোট্ট জানালায় কৌতুহলী শিশুর মুখ দেখতে দেখতে এক সময় দেখলাম চোখে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ঘোর সন্ধ্যা নেমে আসছে। হৃদয়ের গহীন থেকে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করলাম কারণ এই পরিবেশের সাথে আমার জীবনে প্রথম পরিচয়। টান টান উত্তেজনায় হাঁটতে শুরু করলাম। পারতেই হবে যেকোনোভাবে। একদম শেষে দূরে দোকানের আলো দেখা গেল। ইমরান ভাইয়ের ভাষায় এটি ’লাইট অফ হোপ’!!
শুনলে হাস্যকর লাগতে পারে কেন যেন নিজেকে লাল আমস্ট্রন মনে হচ্ছিল!!!
বিভূতিভুষণের 'জলে ডাঙায়' উপন্যাসের সনদ চরিত্র মনে পরল। আমার মতো একজন ছাপোষা মানুষ যে এতোটুকু সময় পেলে ঘুমাতে ভালোবাসে সে জীবনের কোন একদিন এমন দুর্গম পর্বত বনে জঙ্গলে ঝর্ণা দেখার সুযোগ পাবে কে জানতো?
অনেকেই হয়তো বলবেন এতো কষ্ট করে অতো দূরে ঝর্ণা দেখার কী দরকার??
প্রকৃতি তার সবচেয়ে অসামান্য নৈস্বর্গিক সম্পদকে লোকচক্ষুর অন্তরালে আগলে রাখতে পছন্দ করে। প্রকৃতি কেবল যোগ্যতমদেরকেই তার এই সৌন্দর্য্য অবগাহন করার সুযোগ দেয় ।
The finest beauty for fittest !!
প্রায় ৭ঘন্টা (যেতে ৩ ,আসতে ৪) হাঁটার পর এমন লাইন মনে হলো!
যদি সত্যি এ দুর্লভ দৃশ্য দেখতে চান তবে যাবেন, না হলে বাসায় Discovery তেও অনেক দারুন দৃশ্য দেখা যায় ।
জীবনের কোন না কোন সময় কঠিন এর স্বাদ নিয়েও দেখা উচিত। সারা জীবন গল্প করার মত কিছু কঠিন আত্মস্থ করে রাখা উচিত।

কিছু টিপসঃ
বন্ধুর পথে চলার জন্য বন্ধু খুব কম। অসুস্থ হলে তাকে সেখান থেকে ফেরত আনা প্রায় অপারগতার কাছাকাছি। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শারীরিক শক্তির কাছে হার মানলেও মনের বল যেন অটুট থাকে।
দিনে দিনে ট্র্যাকিং করার চেয়ে ট্র্যাকিং করে এক রাত থেকে পরের দিন ঝরনা দেখে আবার ট্রাকিং করলে কষ্ট কম হবে। ওখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
জোঁক এখানে Normal inhabitants.. বলতে গেলে তাদের ওখানে আপনি বেড়াতে যাচ্ছেন। তারা যেন আপনাকে বেশি একটা জামাই আদর না করে তার জন্য মোজা পরে যান।
পাহাড়ের কাছে গেলে নিজে উদার হবেন; বন্ধু বাৎসল হবেন; টিম ওয়ার্কিং এর মর্মার্থ বুঝতে পারবেন।
পর্যাপ্ত শুকনো খাবার এবং পানি স্যালাইন মাস্ট মাস্ট মাস্ট।

আমরা ১১জন‌। দেশের নানা প্রান্তের। খুলনা বরগুনা গোপালগঞ্জ ফরিদপুর চট্টগ্রাম কক্সবাজার যশোর নারায়ণগঞ্জ। জোঁকের কামড় খাইয়া,Severe muscle cramp এর শিকার হইয়া, কাঁদা জলে আছাড় খাইয়া; ১৭ কিলোমিটার থেকে চাঁদ দেখতে দেখতে চাঁদের গাড়িতে ফিরিয়া আসলাম!!
যা ছেড়ে আসতে পারলাম না তাহল শ্বেতশুভ্র ঝর্ণা ,সবুজ পাহাড়, হলুদ প্রজাপতির স্মৃতি।
এত বড় পাহাড়টা, এই ছোট্ট মনে ঢুকিয়ে নেওয়া তো সম্ভব নয়।
ঝর্ণার পানি এনেছিলাম স্রোত আনতে পারিনি।
যে লাঠিটি ধরে পুরোটা সময় হেঁটেছি, সেই বাঁশের লাঠিটি চাঁদের গাড়ি পর্যন্ত সাথে ছিল তারপর আর মনে নেই।
যেটা বুঝলাম সৌখিন মানুষগুলোর প্রত্যেকের মধ্যে এক অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বদ্ধ উন্মাদ বাস করে। আমরা মনের অজান্তেই আমরা এটা দমিয়ে রাখি।
মাত্র একটা দিন আমরা ছুটি চেয়েছিলাম।
আমরা ১১জন।
এটা সারা জীবনের জন্য শুধুমাত্র ছুটির দিন না হয়ে অসাধারণ এক স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে বুঝিনি। শারীরিক কষ্টটা হয়তো কয়দিনের মধ্যেই চলে যাবে কিন্তু দুচোখ ভরে যে সৌন্দর্য অবগাহন করে গেছি হয়তো কোনদিন তা আর ভোলা হবে না।
ভালো থেকো দামতুয়া ঝর্ণা !
ভালো থেকো বান্দরবান!
আবার দেখা হবে!!হবেই!!!