ব্যাথানাশক ওষুধে বিপদ ডেকে আনে পাকস্থলীর

ব্যাথানাশক ওষুধে বিপদ ডেকে আনে পাকস্থলীর

পাকস্থলীর ক্ষত ও আলসার মানব শরীরের জটিল একটি রোগ। সময়মতো সচেতন না হলে এ থেকে মারাত্মক রোগও হতে পারে। আমাদের দেশে ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইন কিলার ফার্মেসির দোকানগুলোতে খুবই সহজে মেলে। কিন্তু যখন তখন ব্যাথানাশক ওষুধ ব্যবহার পাকস্থলীতে ক্ষত হবার অন্যতম কারণ।  এ বিষয়ে ডক্টর টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. সানজিদা হোসেন পাপিয়া

ডক্টর টিভি: পাকস্থলীর ক্ষত আসলে কী?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: পাকস্থলী হলো আমাদের খাদ্যনালীর একটা অংশ।  পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিড তৈরি হয় এবং এখানে একটা হজমের রস বের হয়, যার নাম পেপসিন। এই হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং পেপসিন একসাথে যুক্ত হয়ে পাকস্থলির উপরে থাকা আবরণ মিউকাস মেমব্রেনে একটা ক্ষত তৈরি করে। আমাদের দেহে থাকা হোমিওস্ট্যাসিস অথবা অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের নিয়ন্ত্রণ। এটা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। কিন্তু কিছু কিছু কারণে এই স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং পেপসিন এর জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করে।

১৯৮৪ সালের আগে ধারণা ছিল, পাকস্থলিতে কোন ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে না।  কিন্তু ডা. মার্শাল এবং ওয়ারেন এ ধারণা ভুল প্রমাণিত করলেন।  তারা গবেষণা করে বের করলেন, এই এসিডের মধ্যে এক ধরনের জীবাণু বাস করে।  এই জীবাণুগুলোই এ ক্ষতটা সৃষ্টি করে । এরপরেই পাকস্থলির ক্ষত বা পেপটিক আলসার ডিজিজ, বা গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা ব্যবস্থাটাও পাল্টে গেল। আজ থেকে ৪০ বছর আগে গ্যাসের ওষুধ বেশি ছিল না। তখন এন্টাসিড দিয়ে চিকিৎসা করা হতো। পরে যখন এসিড উৎপন্ন করাতে বাধা দেয়া যায় তখন রেনিটিডিন ওষুধের ব্যবহার করা হলো। পরবর্তীতে ওমিপ্রাজলের ব্যবহার শুরু হলো। মানুষের জীবনাচরণের সাথে চিন্তা-ভাবনা বিষন্নতা, এসব কিছুর সাথে দেহের সবকিছুর সম্পর্ক রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবন পরিচালনার ফলে দেহের অ্যাসিড এবং পেপসিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে আলসারের অবস্থা তৈরি হয়।

ডক্টর টিভি: কি কি লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে বোঝা যাবে পেপটিক আলসার  বা পাকস্থলির ক্ষত হয়েছে?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: পেপটিক আলসার দুই ধরনের। একটা হল স্টমাক আলসার, আরেকটি ডিওডেনাম আলসার। স্টমাকের আলসারকে বলা হয় গ্যাস্ট্রিক আলসার, আর ডিউডেনামের আলসারকে বলা হয় ডিওডেনাম আলসার। এই দুটোকে একত্রে বলা হয় পেপটিক আলসার।

স্টমাক থাকে ওপরের অংশে আর ডিউডেনাম থাকে নিচের অংশে। উপরের অংশে যখন স্টমাক থাকে তখন খাবার খেলেই একটা ক্ষত জায়গায় খাবারটা যাচ্ছে।

দেখা যায়, খাবার খেলেই ব্যথা করে।  গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, খাবার খেলেই পেটে ব্যথা করে।  খাবারটা স্টমাক পার হয়ে ডিউডেনামে যায়, এ সময় কিছুটা সময় চলে যায়।  যার জন্য ডিউডেনাম আলসারের ক্ষেত্রে খালি পেটে পেট ব্যথা করে। দু’টি ক্ষেত্রেই পেটে ব্যথা করে। একটা হলো খালি পেটে, আরেকটি খাবার পর পেটে ব্যথা করে। এর সাথে আরও কিছু উপসর্গ রয়েছে। যেমন, খাওয়ার রুচি কমে যায়, অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি এমন হলে বমি হয়। এখন আমাদের দেশে যেসব ওষুধ রয়েছে, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আসার আগে পেপটিক আলসার একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল। তখন বেশিরভাগ মানুষই দীর্ঘমেয়াদি আলসারে ভুগতেন,  বমি হতো। ৪০ বছর আগে পেপটিক আলসার রোগীদের অপারেশন হত। এখন আলসারের চিকিৎসার উন্নতির ফলে অপারেশন করতে হয় না।

ডক্টর টিভি: আমাদের দেশে ব্যথানাশক ওষুধ ফার্মেসির দোকানগুলোতে খুবই সহজলভ্য। যখন তখন পেইন কিলারের ব্যবহার পাকস্থলির ক্ষত তৈরিতে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না।  তারা ব্যথা অনুভব করলে বা কোথাও আঘাত পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসির দোকান থেকে ব্যথানাশক ওষুধ কিনে নিয়ে খেয়ে থাকেন।  এর ফলে পাকস্থলির আবরণে ক্ষতি হয়।  আবার সেখানে এসিড এবং পেপসিনের মিশ্রণে আলসার সৃষ্টি করে।

ডক্টর টিভি: অনেকের চুকা বা তিতা ঢেকুর ওঠে। এর সঙ্গে পাকস্থলির ক্ষত হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আমরা যখন খাবার খাই সেটা মুখ দিয়ে পাকস্থলিতে যায়। তারপর সেখান থেকে ডিওডেনামে যায়। এটার  যে রিদম, সাইকেল বা চক্র আছে সেটা তখন বন্ধ হয়ে যায়। পাকস্থলি তখন আর সে রকম নড়াচড়া করে না। খাবারগুলো অনেকক্ষণ পাকস্থলিতে থেকে যায় । যার ফলে রোগীরা বলে আমার পেট ভার হয়ে আছে। মানে তার খাবার পাকস্থলিতে ঠেকে গেছে। আর এই খাবারটা বেশি হলে উপরেতো পানি ভাসে, তখন পাকস্থলি দুর্বল হয়ে যায়। আর ওপরে ভাসতে থাকা এসিডগুলো উপরের দিকে চলে আসে। তখন মানুষ ঢেকুর তুলে ওই গ্যাসগুলো বের করে। ওই এসিডটা উপরে উঠে এসে  বুকটা জ্বালাপোড়া করে। আর মানুষ তখনই ঢেকুর তোলে গ্যাসটা বের করার চেষ্টা করে।

ডক্টর টিভি: পাকস্থলির ঘা থেকে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কতটুকু?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: আগে ধারণা ছিল যে, আলসার থেকে ক্যান্সার কিন্তু আলসার থেকে কখনো ক্যান্সার হয়না। আলসারটা প্রকৃতপক্ষে মিস ডায়াগনোসিস। এক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় পদ্ধতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আগে থেকেই বোঝা যায়।

ডক্টর টিভি: দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবারগুলো অনেকের পেটে সমস্যা সৃষ্টি করে। এর সাথে পাকস্থলির ক্ষতের কোন সম্পর্ক আছে কি?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারে এক ধরনের ল্যাকটোস বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় উপাদান আছে। ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই দুধ খেয়ে বড় হয়েছি। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে ৪/৫ বছর পরে আমাদের এই ল্যাকটোজ হজম করার জন্য ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাকটেজ নামক একটা এনজাইম থাকে। সেই ল্যাকটেজ নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে আমরা দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার খেলে সেটা হজম করতে পারি না।  লেকটোস হজম না হলে পেটের মধ্যে একটা অস্বস্তি বা ফোলা ফোলা ভাবের সৃষ্টি হয়। তখন পাকস্থলির স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে পারে। অনেকের দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার খাওয়ার পর ডায়রিয়া হয়। তাই পৃথিবীতে ৮৫ শতাংশ মানুষ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স রোগে ভুগেন।

শুধু দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার নয়, চুইংগাম এবং অনেক খাবার আছে, যেগুলো খেলে পেটের মধ্যে এলার্জি হয়। তখন সেই খাবারগুলো খেলে পেটের মধ্যে ব্যথা হয় এবং পাতলা পায়খানা হয়। এসব খাদ্যনালীর রোগ। যেমন পেটের ফোলা ফোলা ভাব বা পেট ভার হয়ে থাকা, চুকা ঢেকুর। দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় খাবারের ফলে যে সমস্যা হয় তা খাদ্যনালীর রোগ।

অনুলিখন: প্রিয়াঙ্কা হাসান