পাকস্থলীর রোগ নিরাময়ে করণীয়

পাকস্থলীর রোগ নিরাময়ে করণীয়

ফার্মেসির দোকান থেকে যত্রতত্র ব্যথার ওষুধ বা পেইন কিলার কিনে খেলে হতে পারে পাকস্থলীর ক্ষতসহ নানা জটিল রোগ। পাকস্থলীর রোগ থেকে বাঁচার উপায় ও চিকিৎসা নিয়ে ডক্টর টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. সানজিদা হোসেন পাপিয়া

ডক্টর টিভি: গ্যাস্ট্রিক আলসারের জন্য কি অপারেশন জরুরি?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, খাবার খেলেই পেটে ব্যথা করে।  আর ডিউডেনাম আলসার যেহেতু খাবারটা স্টমাক পার হয়ে ডিউডেনামে যায়, এ সময় কিছুটা সময় চলে যায়। যার জন্য ডিউডেনাম আলসারের ক্ষেত্রে খালি পেটে ,পেটে ব্যথা করে।দুটি ক্ষেত্রেই পেটে ব্যথা করে একটা হল খালি পেটে, আরেকটি হচ্ছে খাবার পর পেটে ব্যথা করে। এর সাথে আরও কিছু উপসর্গ রয়েছে যেমন খাওয়ার রুচি কমে যায়, অনেক সময় যখন দীর্ঘমেয়াদি ভাবে থাকে তখন বমি হয়। এখনকার দিনে আমাদের দেশে যেসব ওষুধ রয়েছে এসব গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আসার আগে পেপটিক আলসার একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল।  তখন বেশিরভাগ মানুষই দেখা যেত, তাদের দীর্ঘমেয়াদি আলসারে ভুগতে হতো,  বমি হত। আজ থেকে ৪০ বছর আগে পেপটিক আলসারের রোগীদের অপারেশন হত। এখন আলসারের চিকিৎসার উন্নতির ফলে অপারেশন করতে হয় না।

ডক্টর টিভি: চুকা ঢেকুর বা তিতা ঢেকুর যাতে কমে যায় সেক্ষেত্রে কি কোনো ওষুধ সেবন করতে হবে?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: হ্যাঁ, এক্ষেত্রে তো ওষুধ সেবন করতে হবে অবশ্যই। কিন্তু আসল জিনিস হলো খাবারে কিছু নিয়ম মানতে হবে। খাবার খেতে হবে পরিমাণ মতো এবং পেট কিছুটা খালি রাখতে হবে। পেটটাকে তিন ভাগ করেন, খাবারটা তিন ভাবে খাবেন। একভাগ খাবেন, একভাগ পানি খাবেন এবং একভাগ খালি রাখবেন। এর ফলে খাবারগুলো উপরের দিকে উঠে আসবে না। চুকা ঢেকুর বা তিতা ঢেকুর হবে না মুখ তিতা হবে না। হজমে সহায়তা হবে।এই নিয়ম মানতে হবে যে খাবার খাওয়ার এক ঘন্টা পর পানি খেতে হবে, সেটাও খেতে হবে অল্প অল্প করে বারবার।  তাহলে ঢেকুর তোলা, বুক জ্বালাপোড়া করা, মুখ তিতা হয়ে যাওয়া এই জিনিসগুলো কমে যাবে ৬০ ভাগ। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।

ডক্টর টিভি: এন্ডোস্কোপির কথা শুনলে রোগীরা মনে করেন তার পাকস্থলীর ক্যান্সার হয়েছে। তাই এন্ডোসকপি করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনীহা থাকে। এক্ষেত্রে রোগীদেরকে কিভাবে কাউন্সেলিং করেন?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: আমি ব্যক্তিগতভাবে হাসপাতালে বা প্রাইভেট চেম্বারে রোগীদেরকে বলি যে, এন্ডোস্কোপি খুবই ক্ষণস্থায়ী পরীক্ষা।  এটা ঠিক যে আগেকার দিনে যন্ত্রটা মোটা ছিল, এখন যন্ত্রটা খুব পাতলা হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আপনার কষ্টটা খুবই কম হবে।

যদি আমরা তাদেরকে এভাবে বোঝাই যে, আপনি একটা ইনজেকশন দিলেও  তো একটু ব্যথা পাবেন। যদি মুখে একটু আঙ্গুল দেই সেক্ষেত্রেও একটু কষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে যায়। তাই এন্ডোস্কোপি করলেও একটু কষ্ট হবে। এক্ষেত্রে আপনি একটু দেখবেন যে আপনার শ্বাস নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে। আবার অনেকে ঘুমের ওষুধ খেয়েও এন্ডোস্কোপি করে।

ঘুমের ঔষধ খেয়ে এন্ডোস্কোপি করলে এই কষ্টকর বিষয়টি থাকে না।  ঘুমের ওষুধ খেলে হাসপাতালে থাকতে হবে।  কারণ ঘুমের ওষুধেরও কিছু জটিলতা রয়েছে। তখন হাসপাতালে না থাকলে এন্ডোস্কোপি করা কষ্টজনিত হবে।

সাধারণত এন্ডোস্কোপি করলে আমরা রোগীদের সাথে কথা বলতে বলতে বা হেপনোটাইস করতে করতে এন্ডোস্কোপি করি। এক্ষেত্রে রোগীর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। এটাকে আমরা অনেক সময় ভোকাল অ্যানেস্থেশিয়া বলি। এই ভোকাল অ্যানেসতেসিয়ার গুরুত্ব কিন্তু অনেক।

ডক্টর টিভি: পাকস্থলীর ক্ষত রয়েছে নিশ্চিত হবার পর কতদিন পর্যন্ত এই চিকিৎসা চলতে থাকে? আর সেটি কিসের ওপর নির্ভর করে?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো আলসারকে নিরাময় করা। আমরা প্রথমে এন্ডোসকপি করে আলসার পেলাম, তারপর ওষুধ দিলাম। ওষুধ দেয়ার পর ছয় সপ্তাহ বা ৮ সপ্তাহ দেখার পরে আমাদের আরেকটা ফলোআপ এন্ডোস্কোপি করা উচিত যে, আলসারটা দূর হয়ে গেলো কিনা। মনে করেন একজন রোগী তিনমাস আলসারের ওষুধ খাওয়ার পরেও তার আলসার না শুকালো আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, আমাদের ডায়াগনোসিসে কোনো ভুল আছে কিনা। তবে সাধারণত আট সপ্তাহের মধ্যেই আলসার মূল্যায়ন করা সম্ভব।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিসের রোগীরা ইসোমিপ্রাজল, ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে এসব ওষুধগুলোর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিনা? অথবা এ জাতীয় ওষুধগুলো সর্বোচ্চ কতদিন ধরে খাওয়া যেতে পারে?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: প্রত্যেকটি ওষুধেরই দীর্ঘমেয়াদি অথবা স্বল্পমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। আলসারের যেসব ওষুধ আমরা খাই সেগুলোতে আমাদের উপকার হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী খেলে এর  জটিলতাও বাড়ে।

যেমন আমরা মুখ দিয়ে যে খাবারগুলো খাই তার মধ্যে অনেক জীবাণু থাকে।  এই জীবাণুগুলো পাকস্থলীর এসিডে মারা পড়ে।

এখন যদি আমরা আলসারের ওষুধ দেই, তাহলে এসিড উৎপাদনে বাধা পড়বে এবং খাবারের মধ্য দিয়ে পাকস্থলীতে জীবাণু যাবে। খাদ্যের সাথে জীবাণু গেলে খাদ্যবাহিত বা পানিবাহিত যেসব জীবাণু আছে, সেগুলো বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি করবে। যেমন ডায়রিয়া, জন্ডিস এরকম অনেক কিছুই করবে।  তাই আলসারের ওষুধগুলো যদি দীর্ঘমেয়াদি খাওয়া হলে পেটের এই রোগগুলো দেখা দেয়।

এমনকি ব্রেইনে এফেক্ট পড়ে, কিডনির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।  এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক  ডোজের ওষুধ নিয়মমতো খেতে হবে।

ডক্টর টিভি: বাচ্চাদের কিছুদিন পরপরই পেটে গ্যাস হয়।  খাবার খায় না বমি করে আর টয়লেট কষা হয়।  সেক্ষেত্রে কি করণীয়?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: বাচ্চার বয়স এক বছর পর্যন্ত বাচ্চার জন্য দুধ খুবই আদর্শ খাবার। কিন্তু ৬ মাস বয়সের পর তার খাবারে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। ৯ মাস থেকে ১ বছর বয়সে স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে সবজি দিয়ে একটু খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালে ওই বাচ্চার জন্য সুবিধা হবে।

ডক্টর টিভি: করোনা বা কোভিড এর সময় মানুষ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাদের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: জীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা অনেক বড় জিনিস। আমাদের দেহের মধ্যে একটা ঘড়ি আছে, যেটাকে আমরা বলি বায়োলজিক্যাল ক্লক।  যেমন আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠি এবং রাতে ঘুমাতে যাই।  এই নিয়মটা যদি আমরা পরিবর্তন করে দেই, তাহলে আমাদের দেহে অনেক পরিবর্তন আসবে।

আমরা প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া-দাওয়া করি।  যেমন আমরা দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করি।  এটা আমাদের দেহের জন্য একটি রুটিন হয়ে যায়। কিন্তু রোজার সময় আমরা ভোররাতে সাহরি খাই এবং সন্ধ্যায় ইফতার করি,  দুপুরে কিছু খাই না।

এক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথম চার-পাঁচটি রোজায় আমাদের কষ্ট হয়। যখন রোজায় দুপুরের দিকে খাওয়া হয় না তখন পেটে এসিড সৃষ্টি হয়। কিন্তু আবার যখন ১০ রোজা চলে যায়, তখন বায়োলজিক্যাল ক্লক আমাদের দেহের নিয়মের সাথে মানানসই হয়ে যায়। তখন আর আমাদের খুব বেশি কষ্ট হয় না রোজা রাখলে। তখন আমরা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসি। কিন্তু যাদের দৈনিক খাওয়া দাওয়া নিয়ম মাফিক হয় না তাদের শরীরে এসিড তৈরির প্রবণতা বা হজম রস তৈরির প্রবণতা সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ফলে আমরা খাবার খেলে হজমের সমস্যা হয় এবং দেহেরও অসুবিধা হয়।

তাই ধর্মীয় নিয়ম আমাদের মহানবীর বাণী মেনে চলে পেটকে তিনভাবে ভাগ করতে হবে।  পেটের একভাগ খেতে হবে, একভাগ পানি পান করতে হবে, আর একভাগ খালি রাখতে হবে।

ডক্টর টিভি: এন্ডোস্কোপি রিকমেন্ড ডিওডেনাল আলসার হায়েটাস হারিনার ক্ষেত্রে চিকিৎসা কী?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: হায়েটাস হারিনার সাথে এন্ডোস্কোপির কোন সম্পর্ক নেই।  তবে হ্যাঁ, হায়েটাস হারিনা হলে অ্যাসিড ওপরে ওঠার প্রবণতা বেড়ে যায়। যার জন্য এসিডটা ইসুবিলাসের মধ্যে চলে যায়। পাকস্থলীর মিউকাস মেমব্রেন আর ইসুবিলাসের মিউকাস মেমব্রেন কিন্তু আলাদা।  পাকস্থলী কিন্তু এসিড নিয়ে খুব সুন্দরভাবে বাস করতে পারে। কিন্তু ইসুবিলাসে যখন অ্যাসিড যাবে তখন সমস্যা হবে। তাই হায়েটাস হারিনার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। এক্ষেত্রে খাবার কম করে খাওয়া,খাবার পরে পানি খাওয়া। এগুলো করলেই সাধারণত হায়াটাস হারিনার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়। আর তাও ভালো না হলে সার্জারি করাতে হবে।

ডক্টর টিভি: কারো হঠাৎ করে পেট ব্যথা বা বুক জ্বালাপোড়া করলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ওষুধ গ্রহণে আপনার  পরামর্শ?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: হ্যাঁ অবশ্যই আছে। এখন আমাদের দেশে অনেক ভালো মানের এন্টাসিড ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ তৈরি হচ্ছে। কেউ মিটিংয়ে আছেন, এখন তার হঠাৎ করে বুক জ্বালাপোড়া করছে। এটার মানে হল এসিড সৃষ্টি হয়েছে। আর আমাদের উদ্দেশ্য হলো এসিডকে নিউট্রালাইজ করতে হবে। তখন এই বুক জ্বালাপোড়া কমে যাবে। সেক্ষেত্রে যেকোনো ভালোমানের এন্টাসিড বা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলেই এই বুক জ্বালাপোড়া কমে যাবে। যেকোনো ওমিপ্রাজল বা ইসোমিপ্রাজল খেলেই বুক জ্বালাপোড়া ভালো হয়ে যাবে।

ডক্টর টিভি: ফার্মেসির দোকানগুলো থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ বা পেইন কিলার কিনে খেলে পাকস্থলীর ক্ষত হবার ঝুঁকি বাড়ায়। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করা উচিত। এভাবে বিনা প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ব্যথার ওষুধ খেলে শুধুমাত্র যে আলসার হবে তা নয়, পাকস্থলী ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে জরুরি অপারেশন করাতে হবে ছিদ্র বন্ধ করার জন্য। এছাড়াও মাইক্রোস্কোপিক ব্লিডিং হয়। তার পায়খানার সাথে রক্ত যায়। পরে দেখা যায় একসময় রক্তশূন্যতাও দেখা দেয়। তাই চিকিৎসকের ছাড়পত্র ছাড়া এ জাতীয় ওষুধ বিক্রি বন্ধে নীতিনির্ধারক বা কর্তৃপক্ষকে তদারকি করতে হবে।

ডক্টর টিভি: পাকস্থলীর রোগ নিরাময়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ কী?

অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর: অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার, কোলডড্রিংস, কার্বনেটেড ড্রিংস, অ্যালকোহল, ধূমপান পরিহার করুন।  তাহলে আলসারের এই যত ওষুধ সেগুলো আর লাগে না।

আমি মনে করি হেলদি ফুড মেনু এবং খাদ্যাভাস ৬০ভাগ বুক জ্বালাপোড়া, পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমিয়ে আনতে পারে।

অনুলিখন: প্রিয়াঙ্কা হাসান