ওএসডি চিকিৎসকও হাসপাতালে সেবা দেন

ওএসডি চিকিৎসকও হাসপাতালে সেবা দেন

ওএসডি
চিকিৎসক - ফাইল ছবি

ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই বিষয়টা ডাক্তারদের জন্যে একটু ভিন্ন। এই পেশায় যারা ওএসডি তারা সবাই হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা নিতে তারা শুধু বই পড়েন না, দিন রাত ওই হাসপাতালে রোগীর সেবা দেন। কারণ ডাক্তারি পেশায় শুধু বই পড়ে ডাক্তার হওয়া যায় না। রোগীই তাকে ডাক্তার তৈরি করে। 

শনিবার (৯ মার্চ) একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ওএসডি হওয়া চিকিৎসকদের নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের প্রতিবাদ জানিয়ে ডক্টর টিভিকে এসব কথা বলেন ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা। 

হিমেল (ছদ্মনাম) নামের ওই চিকিৎসক ডক্টর টিভিকে জানান, আমি আমার পোস্ট গ্রেড পড়ার জন্য ২৬ সাল জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা ছুটি বা ডেপুটেশনে আছি। আমার মূল পদায়ন ওএসডি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওএসডি মানে বাসায় বসে বা ভার্সিটিতে বইসা পাচ বছর বেতন তোলা নয়। বিষয়টা এমন নয় যে, আমি শুধু পড়তে আসছি। বরং প্রতিদিন সকালে আটটার পরে হাসপাতালে গিয়ে রোগী ফলোআপ দেই। তারপর এক ঘন্টা একাডেমিক ডিসকাশন ইন মর্নিং সেশন। সকল প্রফেসররা থাকেন। তারপর আবার প্রফেসর স্যারের সাথে রাউন্ড দিয়ে ১৫০-২০০ রোগী দেখা। এরপর আবার এক ঘন্টা ক্লাস। আমাদের পোস্ট গ্রেডে পড়ালেখা করি, রোগী দেখি, সিসিইউ তে ডিউটি করি, রোগীর সব কাজ আমার লেভেল এর চিকিৎসকরাই করি। তিন বছরে হাতে-কলমে শিখে এমডি পরীক্ষায় বসতে পারব। বাই প্রোডাক্ট হিসেবে ঐ দিকে রোগীরাও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পাচ্ছে। এটা ছয় দিনের রুটিন। এর বাইরে প্রতি সপ্তাহে ২ দিন ১২×২=২৪ ঘন্টা নাইট ডিউটি করা লাগে। 

তাঁর দাবি, আমার মত ওএসডি চিকিৎসক ঢাকার বিশেষায়িত হাসপাতালে না থাকলে এখানে কারা চিকিৎসা দিতেন?

ডা. আল-মামুন নামের অপর এক চিকিৎসক বলেন, একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে কতটা নিম্নমানের সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা জানে না যে, ডাক্তারদের ওএসডি আর প্রশাসনের অন্যদের ওএসডি এক নয়। কারণ ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ওএসডি সরকারী এক প্রতিষ্ঠান হতে আরেক সরকারী প্রতিষ্ঠানে পদায়ন।ওএসডি হিসাবে আমি উপজেলা হাসপাতালে কাজ করেছি আড়াই বছর। অথচ পত্রিকাটি লিখেছে চিকিৎসায় নেই ২১ %! কি ভয়াবহ অসত্য সংবাদ।

উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে ওএসডি হওয়া অপর একজন চিকিৎসক ক্ষুব্ধ ভাষায় এই সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, চিকিৎসায় নেই ২১% চিকিৎসক- এই শিরোনাম দেখে আমার ২টা বিষয় মনে হয়। একটি হলো হয়তো আপনার এই বিষয়ে যোগ্যতায় ঘাটতি আছে, যেটা আপনি ইচ্ছা করলেই উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিলে সমাধান সম্ভব। অন্যটি আপনি ইচ্ছা করে আপনার লেখার ভিউ বাড়ানোর জন্যে এই শিরোনাম করছেন, যা সাধারণ মানুষকে একটা ভূল তথ্য দিবে এবং এটা আমার কাছে অপরাধ মনে হয়।

আপনি ৪টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এটা সঠিক। কিন্তু ভিতরে কিছু ভুল আছে।

১) উচ্চ শিক্ষার জন্যে ছুটি- উচ্চ শিক্ষার জন্যে যারা ছুটিতে থাকে তার ৮৫% ক্লিনিক্যাল সাবজেক্ট এ। তারা অবশ্যই কোনো সরকারি মেডিক্যাল কলেজে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন। এবং আপনি খোঁজ নিলে অবশ্যই অবাক হবেন- তারা ওই বিশেষায়িত সাবজেক্টের ডিপার্টমেন্টে দৈনিক নূন্যতম ১০ ঘণ্টা রুগীকে সেবা প্রদান করেন। এমনও হয় তারা ইফতারি বা সেহেরী করারও সময় পান না। সারারাত ধরে তারা অপারেশন করেন। তাদের বাদ দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোনো ডিপার্টমেন্ট কল্পনা করা যায় না। অন্য পেশার উচ্চশিক্ষার ওএসডি আর ডাক্তারদের ওএসডি এক না। তারা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিন রাত সেবা দেয়। আপনি কষ্ট করে একদিন ঢাকা মেডিকেল এ যাবেন এবং খোঁজ নিবেন। আর বাকি ১৫% বেসিক সাবজেক্টে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের সাথে রুগীর সম্পর্ক আরো বেশি। কারণ তারাই ডাক্তার তৈরি করবে, তারাই মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ ডাক্তার বানাবে। আর জেনে অবাক হবেন এই উচ্চতর ডিগ্রী ছাড়া স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রমোশন হয় না। তাই এটা তো করতেই হবে।

২) ছুটি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা- অধ্যাপক স্যারগণ ওএসডি হিসেবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই কাজ করেন, রুগী দেখেন। যারা প্রশাসনিক কাজ করেন তাদের কাজ আরো বেশি। তাদের হাত ধরেই হাসপাতালের সকল প্রশাসনিক কাজ হয়। লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এমন চিকিৎসক একেবারেই নগণ্য।

৩) পদের থেকে বেশি পদোন্নতি- এ বিষয়ে আমি বলবো অন্য ক্যাডার থেকে এই স্বাস্থ্য ক্যাডারে পদোন্নতি অনেক কম। সব যোগ্যতা পূরণ করেও তারা প্রমোশন না পেয়ে নিম্ন পদে কাজ করছে। আর যদি আসলেই পদ না থাকে তাহলে প্রশাসন ক্যাডারের মত এই ক্যাডারে পদ দ্বিগুণ করতে হবে। তবে পদের থেকে পদোন্নতি বেশির কারণেও যদি ওএসডি করা হয়, তারা চিকিৎসা না দিয়ে বেতন নিচ্ছেন- এটা ভুল। তারা সরকারি হসপিটালে রুগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। জাস্ট পদ না থাকার কারণে তাকে ওএসডি দেখিয়ে কোনো সরকারি হাসপাতালে সংযুক্ত করেছেন। তিনি প্রতিদিন রুগী দেখছেন।

৪) অপরাধের শাস্তি- জি ওনারা বসে বসে সরকারের কাছ থেকে কিছু পারিতোষিক নিচ্ছেন। আপনার ৭৫০০ জন ওএসডি’র মধ্যে ওনাদের সংখ্যা ৫০ জন। 

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান (ল্যাব) ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটো ডক্টর টিভিকে জানান, ঠিকমত না জেনে রিপোর্ট করায় মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে বহুল প্রচারিত পত্রিকাটি। চিকিৎসকদের ওএসডির নিয়মনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি খোঁজ না নিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ওএসডি হওয়া চিকিৎসক কোথায় আছেন, কী করছেন- এ বিষয়টার খোঁজ নিলেই প্রকৃত সত্য জানতে পারতেন রিপোর্টার। তিনি এটা করেননি। বিষয়টা দুঃখজনক।  

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ ডক্টর টিভিকে বলেন, প্রশাসনের অন্য বিভাগের মত চিকিৎসকদের ওএসডি এক নয়। চিকিৎসকদের ওএসডি করার কারণ পুরোপুরি না জেনেই রিপোর্ট করেছে বিশেষ একটি পত্রিকা। যেটা পাঠকদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। প্রকৃত অর্থে সরকারি চাকুরিরত কোন চিকিৎসকেরই কর্মের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। 

তিনি আরও জানান, চিকিৎসকদের ৯০ ভাগ ওএসডি হয়ে থাকে প্রেষণজনিত। উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও শিক্ষালাভের জন্য তাদেরকে ওএসডি করে বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজে প্রেষণে পদায়ন করা হয়। এভাবে সরকারি নিয়ম মেনেই এক কর্মস্থলের বদলে আরেক কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন তথা রোগীর চিকিৎসাকর্মে নিয়োজিত থাকেন তারা। 

দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এমডি, এমএস কিংবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিতে আসা তরুণ চিকিৎসরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই ওএসডি হন। কারণ ওএসডি হওয়া এসব চিকিৎসকই আগামী দিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। 

আরও পড়ুনঃ প্রথম আলোর প্রতিবেদন এবং প্রাসঙ্গিক কথা


আরও দেখুন: