একটি হাসপাতালের জন্মগাঁথা

একটি হাসপাতালের জন্মগাঁথা

ইতিহাস
কালীতারা চিকিৎসালয়ের জন্মগাঁথা (ইনসেটে ডা. মো. তরিকুল হাসান) - সংগৃহীত

বাবু কলকাতা থেকে কবে এলেন?
গতকালই এলুম। এদিককার কি খবর?


বলতে বলতে আরেক ছিলিম তামাক হুকোয় ভরতে বললেন ঈশান বাবু। কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে লাঠিটা হাতে নিয়ে হাটতে বেরোলেন। শীত পড়তে শুরু করেছে। ভোরের কুয়াশা সবেমাত্র কেটেছে। তবে ঠান্ডার রেশ কমেনি এক রত্তি। 


এবার বড় ছেলে প্রফুল্লকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। শেয়ারের দরের উঠানামাটা নিয়ে একমনে ভাবলেন কিছুক্ষণ।  হঠাৎ ছেলেকে লাঠি উচিয়ে ঝোপের একপাশটা দেখিয়ে বললেন, তোমার ঠাকুরমার নামে এখানে একটা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি করলে কেমন হয়? এ অঞ্চলে বড্ড ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। 


প্রফুল্ল বাবু রবার্ট হ্যারিকের মেটাফর শিশির বিন্দুর মুক্তা নিয়ে ভাবছিলেন। ভাবনায় একটু ছেদ পড়লো।  ঘাড় নেড়ে বাবার কথায় সায় দিলেন তিনি। তার বাবা দিনদিন শিশুর মতো হয়ে উঠছেন। এই গ্রামে খুব কষ্টে বাবার শৈশব কেটেছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে খেয়ে না খেয়ে তার ঠাকুরমা কালীতারা তাকে বড় করে তুলছিলেন। একসময় বংগেশ্বরদী পাঠশালায় পড়তে যান বাবা। তাও পরান্নে লালিত হয়ে। সেই অবস্থা থেকে আজ তিনি কলকাতার সবচেয়ে ধনীদের একজন।


বিকেলে সরকার সাহেবকে ডেকে পাঠালেন ঈশান বাবু। একসময় গোহাইলবাড়ীর কুণ্ডুদের অনুগ্রহ পেয়েছিলেন তিনি। আজ কুন্ডুদের খুব অসময় যাচ্ছে। পুরনো অনুগ্রহের কথা মাথায় রেখে তার জমিদারির সরকার হিসেবে কুণ্ডুদেরই একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। সাতৈরের বিখ্যাত শীতলপাটি মেঝেতে বিছানো হয়েছে। গরম গরম লুচি আর ছানার সন্দেশ খেতে খেতে ঈশান বাবু গম্ভীর গলায় বললেন,


'বুঝলে কুন্ডু দুটি ট্রাস্ট এর কাগজপত্তর বানাও। একটা মা কালী তারার নামে এই গাঁয়ে আর আরেকটি বংগেশ্বরদী গাঁয়ে শশীমুখীর নামে!'


আজ খরসূতীবাসীদের জন্য খুব আনন্দের দিন। আজ কালী তারা ট্রাস্ট গঠিত হলো। একটি ছয় শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল গঠিত হবে। জমি দেয়া হলো ৩ একর ৬৬ শতাংশ। এই ট্রাস্ট যতদিন ঈশান চন্দ্র ঘোষ জীবিত থাকবেন ততদিন তিনিই এর নির্বাহ করবেন। এরপর বড় ছেলে প্রফুল্লকে বলে গেলেন এর দেখভাল করতে। 

বড় ভবন বানানো হলো। আশপাশের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হলো। ভবনের চারপাশে সাপ তাড়াতে ছিটানো হলো কার্বলিক এসিড। 

প্রফুল্লচন্দ্র বড় ব্যস্ত মানুষ। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনায় তার পাণ্ডিত্যের খবর পৌঁছে গেছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে। ছোটভাই প্রতুল চন্দ্র তাই গাঁয়ের মুরুব্বি ময়েজ উদ্দিন মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে এই ট্রাস্টের দায়িত্ব নিলেন। দুজনে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে নতুনভাবে গড়ে তুললেন দাতব্য চিকিৎসালয়কে।

এরপর মধুমতী নদীতে বয়ে গেছে অনেক জল।

দেশভাগ হলো। যে চরম আশা নিয়ে আজাদীর স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল, দেখা গেল তা পুরন হবার নয়। শুরু হলো নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। 


যুদ্ধ শেষ হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা বীরের বেশে ফিরে এলেন। ফিরে এলেন আবদুর রউফ মাস্টার, আলাউদ্দিন আহম্মদসহ আরো অনেকে। 


শুরু হলো দেশ গড়ার নতুন সংগ্রাম। এ অনেক বড় সংগ্রাম। বেসরকারিভাবে হাসপাতাল পরিচালনা করা দূরুহ হয়ে গেল। কলকাতা থেকে বাবুরা আর তেমন সাহায্য করছেন না। 


২৪শে জানুয়ারী ১৯৭৫।


জনাব আলাউদ্দিন আহম্মদের সভাপতিত্ত্বে কালী তারা ট্রাস্টের ১৭তম বৈঠক বসলো। বৈঠকে উপস্থিত আছেন সর্বজনাব-


আবদুর রউফ মাস্টার এমএ বিএড
সাজ্জাদ হোসেন
ইমাম হোসেন
বাবু সত্যেন্দ্র রায় (মেডিকেল অফিসার)
মো. লোকমান হোসেন
মো. আবদুর রশীদ মোল্লা
মো. আবদুল হাকিম মোল্লা।


সভায় জনাব আবদুর রউফ এমএ বিএড প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, বাংলাদেশ সরকারের মেমো নং, CS7/65 1.1.75 অনুযায়ী, অত্র দাতব্য চিকিৎসালয়ের সবকিছু সিভিল সার্জন বরাবর প্রেরণ করে এই হাসপাতালকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হোক। সবাই সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি সমর্থন করলেন।


জন্ম হলো নতুন নামে একটি হাসপাতাল, খরসূতী (ময়না) ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র। 

লেখকঃ

ডা. মো. তরিকুল হাসান, 
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য).
এমডি ফেজ-বি নিউরোলজি রেসিডেন্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। 


তথ্যসূত্রঃ


১। জাতক (ঈশান চন্দ্র ঘোষ অনূদিত) এর ভুমিকা।
২। ফরিদপুরের ইতিহাস, শ্রী আনন্দনাথ রায়।
৩। মিটিং বই, কালীতারা ট্রাস্ট।
৪। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলাউদ্দিন আহম্মদ, প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ঘোষপুর ইউনিয়ন। 
৫। জনাব নাদের আলী, বয়স আনুমানিক ১২৭ বছর।
৬। জনাব পবন শেখ, বয়স আনুমানিক ১১২ বছর।