বাত ও ব্যথার রিজেনারেটিভ চিকিৎসা

বাত ও ব্যথার রিজেনারেটিভ চিকিৎসা

বাতব্যথা
বাত ও ব্যথার রিজেনারেটিভ চিকিৎসা (ইনসেটে ডা. মন্জুর এ খোদা) - ফাইল ছবি

সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে শুধুমাত্র গিটে গিটে ব্যথাই বোধকরি বাতব্যথার একমাত্র লক্ষণ এবং আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা এই বাতরোগ এটি শুধুমাত্র প্রবীণ বা বয়স্কদেরই হয়ে থাকে, অন্য কারো নয়। শিশু থেকে প্রৌঢ় সকল বয়সে বাত ও অন্যান্য ব্যথার বয়সভিত্তিক কারণ রয়েছে। বয়সজনিত ও যেকোন ধরনের ব্যথায় আমাদের সজীবতা, স্ট্যামিনা বা তারুণ্য হারিয়ে আমরা মুষড়ে পড়ি। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন সেবা দেয়া সম্ভব যে ওষুধ ছাড়াই আমরা তারুণ্য বা সজীবতা ধরে রাখতে পারি বা লক্ষণ মুক্তভাবে চলতে পারি।

বাতরোগের আধুনিক চিকিৎসাঃ

বাতরোগের চিকিৎসা প্রথাগতভাবে স্টেরয়েড ধরনের ব্যথানাশক প্রয়োগ আর মুখে খাওয়ার সাধারণ প্রদাহবিনাশী বড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাত ও যেকোন ব্যথার সর্বাধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি হলো HLA A B DR Genotyping. লুক্কায়িত আর্থ্রাইটিস নির্ণয় করা যায়। আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে যেমন রক্তপরীক্ষা ও ডিএনএ পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ এখন আর অজানা থাকছে না, সম্পূর্ণ ডায়াগনসিস করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগলক্ষণ প্রশমিত করা সম্ভব। এছাড়াও সহযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি (হস্তগত ব্যায়াম ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্ত অস্থিসন্ধিকে নমনীয় করা হয়) প্রয়োগ করে বাত উপশম করা যায়। 


খাদ্যাভাসঃ

পাশাপাশি বাত প্রতিরোধে খাদ্যাভাসের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। যেমন, 

১. হলুদ বা কিউকারমিন, ২. আদা, ৩. গ্রীণ টি বা ক্যাটেকিন, ৪. আনারস
৫. চেরিফল বা এর রস ৬. টক ফল মাল্টা, কমলা, লেবু ৭. যেকোন বেরি যেমন, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, মালবেরি ৮. গাজর ৯. অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল ১০. মোটা শস্য বা হোল গ্রেইন বা ওটস।

এগুলো বাত বা প্রদাহ প্রতিরোধী খাবার হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত।

রিজেনারেটিভ চিকিৎসা কেন দরকার?

শুধু ব্যথানাশক ওষুধ আর স্টেরয়েড/বাত নিরোধক ওষুধ এসব ব্যথার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারেনা, সাময়িক ব্যথা হ্রাস করতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে পাকস্থলি আলসার, কিডনি রোগ ও ইনফেকশনের কারন হলো এসব ওষুধ। রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে এমন উপাদান পৃথকিকরন করা হয়, যেগুলোর মাধ্যমে ক্ষয়িষ্ণু অস্থিসন্ধির পুনর্জাগরন করা সম্ভব হয়। 

যেমনঃ

১। বিশেষ কোন অস্থিসন্ধির আবরণী বা কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে গেলে বা 

২। দুই হাড়ের মধ্যবর্তী ঘর্ষণরোধী তরল জেল শুকিয়ে যায়

৩। হাড় গুলোকে সংযোগকারি লিগামেন্ট বা টেন্ডন রজ্জু ছিড়ে যায়

৪। অস্থিসন্ধির মধ্যে প্রদাহজনিত তরল জমা হলে রক্তের T কোষের অতিক্রিয়া দেখা যায়। 


এগুলো ক্ষয়পূরণ করতে প্রয়োজন বিশেষ গ্রোথ ফ্যাক্টর, প্রোটিন, পেপটাইড ও সাইটোকাইনসমূহ যার কোনটিই ওষুধের মাধ্যমে ক্ষয়পূরণ বা পুনঃসৃষ্টি সম্ভব নয় তাই, যেকোন ব্যথার বায়োলজিক চিকিৎসা হলো সবচেয়ে নিরাপদ ও সম্পূর্ণ পার্শ্বক্রিয়া মুক্ত।

উল্লেখযোগ্য রিজেনারেটিভ প্রোডাক্টঃ

১। বায়োলজিক এন্টিবডি (MABs)

২। রোগীর নিজের অনুচক্রিকা পূর্ণ রক্তরস (প্লাজমা) PRP

৩। রক্তের অণুচক্রিকা নিঃসৃত প্রোটিন (PL)

৪। রোগির অস্থিমজ্জা বা চর্বি থেকে সংগৃহিত রস (BMAC or SVF)

৫। মাইক্রো চর্বি বা চর্বির কণা (mFAT)

৬। নবজাতকের নাভিরজ্জু থেকে সংগৃহিত স্টেমসেল (MSC)

৭। স্বর্ন দ্বারা পরিশুদ্ধ রক্তরস (GOLDIC)


বায়োলজিক চিকিৎসাঃ সাধারণ বাংলায় বললে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এর অর্থ যেসব এন্টিবডি রক্তে বেশি মাত্রায় থাকার বলে অটোইমিউন বাতরোগ হচ্ছে সেসব এন্টিবডির বিরুদ্ধে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করে রক্তে থাকা ক্ষতিকর বাতসৃষ্টিকারী এন্টিবডি ধ্বংস করা হচ্ছে। এগুলো বিশেষ ধরনের ব্যথামুক্ত ইনজেকশন যা ত্বকের নিচে বা শিরাপথে দিলে রোগ উপশম হচ্ছে। 

পিআরপিঃ আঘাতজনিত বা বয়সজনিত অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত কাঁধের ব্যথায় যুগান্তকারী চিকিৎসা পিআরপি। রোগির রক্ত থেকে ছাঁকনকৃত রক্তের হলুদ অংশের মধ্যে যে অনুচক্রিকা থাকে সেটিকে পৃথক করে, এই হলুদ তরলটি আক্রান্ত অস্থিসন্ধির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের অনুচক্রিকার মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান বা গ্রোথফ্যাক্টর ক্ষয় হয়ে যাওয়া অস্থিসন্ধির পুনর্জাগরণের খাদ্য হিসেবে কাজ করে ব্যথা নিরাময় করে।


রক্তের অণুচক্রিকা নিঃসৃত প্রোটিন(PL)ঃ রক্তের অণুচক্রিকা পৃথকিকরনের পর সেই কোষ ভাঙনের ফলে সেখান থেকে যে বিশেষ নির্যাস নির্গত হয় যেমন, গ্রোথ ফ্যাক্টর, প্রোটিন, পেপটাইড ও সাইটোকাইনসমূহ এগুলোই মূলত অস্থিসন্ধির ক্ষয় পূরন করে।কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হলো আলফা ২ মাইক্রোগ্লোবিউলিন (A2M) ও ইন্টারলিউকিন রিসেপটর এন্টাগনিস্ট প্রোটিন(IRAP)।  


রোগির অস্থিমজ্জা বা চর্বি থেকে সংগৃহিত রস (BMAC or SVF)ঃ রোগির অস্থিমজ্জার মধ্যে যে শ্বেতকনিকা(বোন ম্যারো কনসেনট্রেট মনো নিউক্লিয়ার সেল) স্টেমসেল থাকে সেগুলোকে পৃথকীকরণ করা হয়। আবার লাইপোসাকশনের মাধ্যমে সংগৃহিত চর্বি থেকে রক্তনালীসমৃদ্ধ চর্বিনির্যাস বা স্ট্রোমাল ভাসকুলার ফ্র্যাকশন সেটিকে ব্যথাযুক্ত অস্থিসন্ধিতে স্থাপন করলে, ব্যথামুক্ত ভাবে রোগ নিরাময় সম্ভব।

মাইক্রো চর্বি বা চর্বির কণা (mFAT)ঃ লাইপোসাকশনের মাধ্যমে সংগৃহিত চর্বি থেকে রক্তনালী ছাড়া চর্বিনির্যাস  বা মাইক্রোনাইজড ফ্যাট বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে সেটিকে ব্যথাযুক্ত অস্থিসন্ধিতে স্থাপন করলে, ব্যথামুক্ত ভাবে রোগ নিরাময় সম্ভব।

স্টেমসেল থেরাপিঃ ক্ষয়িষ্ণু অস্থিসন্ধিকে আবার পুনর্জাগরণী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল গবেষণা স্টেমসেলকে ঘিরে। নবজাতকের নাভিরজ্জু/প্লাসেন্টা থেকে সংগৃহিত মেসেনকাইমাল স্টেমসেল (MSC) বা মাতৃ কোষগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাঁকন করে সেই বিশুদ্ধ স্টেমসেল তরল আকান্ত অস্থিসন্ধি বা অঙ্গে প্রতিস্থাপন করলে সেই অঙ্গে নতুনভাবে কোষবিভাজনের ফলে আক্রান্ত অস্থিসন্ধি পুনরায় নড়নক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে।

 স্বর্ন দ্বারা পরিশুদ্ধ রক্তরস (GOLDIC)ঃ রোগীর রক্ত সংগ্রহ করে তাকে স্বর্ণের ন্যানো পার্টিকেল সমৃদ্ধ টেস্টটিউবে ২৪ ঘন্টা সংরক্ষন বা ইনকিউবেশন করে রাখার পর সেখান থেকে যে বিশেষ রক্তরস বা প্রোটিন সমৃদ্ধ সোনালি বর্ণের তরল পাওয়া যায়, সেটি হলো গোল্ড ইনডিউসড সাইটোকাইন (গোল্ডীক)। এটি

পুনর্জাগরণী সক্ষমতা এমন যে কয়েকটি প্রয়োগঃ

১। কোমর বা ঘাড়ে যে ডিস্ক প্রোলাপস জনিত সায়াটিকা ব্যথা হয়, সেটিকে এপিডুরাল বা মেরদন্ড আবরনীর বাইরে স্থাপন করলে নিরাময় করা সম্ভব। 

২। বয়সজনিত যে হাঁটু ব্যথা বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়, গ্রেড ৪ হলে হাঁটু প্রতিস্থাপন করতে বলা হয়, সেটির ব্যথাও গোল্ডিক রক্তরস প্রদানে নিরাময় ঘটে। 

৩। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (সকালে ওঠার পর গেঁটেবাত) বা চর্মরোগজনিত সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এর ক্ষেত্রে শিরাপথে গোল্ডিক রক্তরস প্রদানে নিরাময় ঘটে। যা গবেষনা দ্বারা প্রমাণিত।


হায়ালুরনিক জেল চিকিৎসাঃ দুটো হাড়ের ঘর্ষণ প্রতিরোধী আঠালো তরল হলো হায়ালুরনিক এসিড। প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গেলে যে বাতব্যথা হয়, তা উপশমের জন্য, সেখানে পুনরায় সেই হায়ালুরনিক জেল প্রতিস্হাপন করা হয়, এর ফলে আন্ত:হাড় ঘর্ষণ হয়না, এতে ব্যথা নিরাময় হয়।

প্রো-বায়োটিক থেরাপিঃ বলা হয়ে থাকে, সচল অটোইমিউন বাতের উৎস পরিপাক নালীতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য আর উপকারী ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পাওয়া। তাই, উপকারী ব্যাকটেরিয়া খাদ্যে গ্রহণের মাধ্যমে রক্তে এন্টিবডি তৈরির প্রবণতা কমানো যায়।


এইসমস্ত আধুনিক চিকিৎসাগুলোর কোনটি কোন ধরনের রোগীর জন্য প্রযোজ্য তা রোগীর রোগের অবস্হা, জটিলতা ও অর্থনৈতিক অবস্হার সাথে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করবেন একজন ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট। তাই, বিচলিত না হয়ে বাতরোগের যেকোন লক্ষণ অনুভব করলেই পরামর্শ নিন একজন রেজিস্টার্ড বাতব্যথা বিশেষজ্ঞের।

লিখেছেন-

ডা. মন্জুর এ খোদা
এমবিবিএস (আর ইউ), এমআরসিপি (লন্ডন, ইউ্কে) 
ইউলার ইসিআরডি ইন রিউমাটোলজি, সুইজারল্যান্ড।
ইর্ন্টানাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি (বাত) বিশেষজ্ঞ।

এক্স স্পেশালিস্ট, ইউনাইটেড হসপিটাল,গুলশান, ঢাকা
হেড অব রিউমাটোলজি, বেটারলাইফ হাসপাতাল, রামপুরা, ঢাকা
ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট, টটিসেল, ঢাকা
কনসালটেন্ট, পপুলার ডায়াগনস্টিকস, ঢাকা ও রাজশাহী।