বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা হার্টের অসুখ নাকি অন্যকিছু?

ডা. ইসমাইল আজহারি

সিইও, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ

বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা হার্টের অসুখ নাকি অন্যকিছু?

হৃদরোগ
বুকের বাম পাশে ব্যথার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে খুব সাধারণ ৪টি কারণ উল্লেখযোগ্য। - প্রতীকী ছবি

অনেক মানুষকেই বলতে শোনা যায় যে, বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যাথা করে। কিছুক্ষণ হাঁটলে হাঁপিয়ে যায় কিংবা বুক জ্যাম হয়ে আছে বলে মনে হয়।

আসুন জেনে নিই, এই ব্যথা কি হার্টের সমস্যার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে হচ্ছে এবং তা বুঝার উপায় কী?

বুকের বাম পাশে ব্যথার কারণ

বুকের বাম পাশে ব্যথার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে খুব সাধারণ ৪টি কারণ উল্লেখযোগ্য-

১. আইএইচডি বা হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জমা হওয়া

২. হার্ট অ্যাটাক

৩. প্যানিক অ্যাটাক

৪. গ্যাস্ট্রাইটিস বা অ্যাসিডিটি সমস্যা

১. আইএইচডি বা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ যেভাবে বুঝবেন

সাধারণত আমরা হৃদরোগ বলতে যা বুঝি, তা মূলত ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজকেই বুঝাই। এই রোগে হার্টের মধ্যে যে রক্তনালিগুলি আছে, তাতে চর্বি জমে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় তাই ব্যথা অনুভব হয়। সাধারণত এই রোগ ৪০ বছরের আগে হয় না। যাদের এই রোগ থাকে, তাদের অধিকাংশেরই হাই ব্লাড প্রেশার থাকে। তাই কারও যদি বয়স ৪০ এর অধিক হয় এবং বুকে চিনচিন ব্যথা করে এবং তার হাইপ্রেশার থাকে তাহলে হৃদরোগের কথা মাথায় রাখতে হবে।

এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ ভারী কাজকর্ম করলে কিংবা একটু হাঁটাহাঁটি করলে কিংবা সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়, হাঁপিয়ে উঠে এবং শ্বাস নিতে ব্যথা অনুভব হয়। বুক ধড়পড় করে, ব্যথা বাম বাহু ও ঘাড়ের দিকেও যেতে পারে। একই সঙ্গে শরীর ঘামিয়ে যেতে পারে এবং কিছুক্ষণ পর আবার এই ব্যাথা চলে যায়।

এ রকম দু-একদিন পরপর হতে পারে। আবার খাবার বেশি খেলেও চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। কারণ, খাবারের পর কিংবা ভারী কাজকর্ম করলে কিংবা হাঁটাহাঁটি করলে হার্টের অধিক পরিমাণ রক্তের দরকার হয়। তবে যাদের ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ রয়েছে, তাদের রক্ত সঞ্চালন কম হয় তাই এই ব্যথা হয়।

করণীয়

জরুরি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে হবে। ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম ও রক্তে চর্বির পরিমাণ দেখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা করতে হবে।

যদি প্রেশার বেশি থাকে তা নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য ওষুধ খেতে হবে। হার্টের ওপর কাজের চাপ কমানোর জন্য ওষুধ খেতে হবে। কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ এবং রক্ত চলাচল সচল রাখার ওষুধ খাওয়া লাগতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ কখনো বন্ধ করা যাবে না। চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণ, ধূমপান, অ্যালকোহল ইত্যাদি পরিহার করে চলতে হবে। লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে।

২. হার্ট অ্যাটাকজনিত বুকে ব্যথা

সাধারণত ৪০ বছরের নিচে হার্ট অ্যাটাক হয় না। যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে, তাদের আগে থেকেই হাই ব্লাড প্রেশার কিংবা রক্তনালিজনিত রোগ ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ থেকে থাকতে পারে। অধিকাংশ হার্ট অ্যাটাক রোগীর ইতিহাস নিয়ে জানা যায়, যেদিন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ওই দিন কিংবা আগের দিন তারা প্রেশারের ওষুধ খাননি, তাই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।

এমন অনেক আছে, তাদের যে হাই প্রেশার রয়েছে কিংবা আগে থেকে হৃদরোগ আছে কখনো চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার কারণে তারা তা জানতেই পারে না। দেখা যায়, সবাই বলাবলি করে সকালে সুস্থ দেখলাম, হঠাৎ ঘুরে পড়ে মারা গেছেন।

হার্ট অ্যাটাকের ব্যাথা যেভাবে বুঝবেন

বয়স সাধারণত ৪০ এর অধিক হয়ে থাকে। আগে থেকে তার হাই ব্লাড প্রেশার ছিল কিংবা অন্য কোনো হৃদরোগ ছিল। হঠাৎ খাবারের পর কিংবা কোনো জার্নি করার পর কিংবা হাঁটাহাঁটি বা ভারী কোনো কাজকর্ম করার পর অথবা কারো সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলার পর কিংবা কোনো দুঃশ্চিতার সময় বুকের বাম পাশে চাপচাপ ব্যথা শুরু হয়। মন হবে বুক জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। ব্যথা পর্যায়ক্রমে বাড়তেই থাকবে, ব্যথা পেটের দিকে, পিঠের দিকে, বাম বাহুর দিকে ও ঘাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়বে। ব্যথার তীব্রতায় রোগী দাঁড়ানো থেকে বুক ধরে বসে যাবে কিংবা শুয়ে পড়বে, কপালে-মুখে ঘাম দেখা দেবে।

বমিবমি ভাব অথবা বমি হয়ে যাবে। ব্যাথা কমবে না, বাড়তেই থাকবে। সাধারণত ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজের ব্যথায় রোগী পেছনে কিছুতে হ্যালান দিয়ে বসলে ব্যথা কমে যায়। তবে হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে ব্যথার তীব্রতা বাড়বে, ব্যথা কমবে না। তীব্র হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে, সঠিক সময় চিকিৎসা করাতে না পারলে রোগী মারা যেতে পারে।

করণীয়

যদি হার্ট অ্যাটাক বুঝতে পারেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা হিসেবে ৪টা অ্যাসপিরিন ৭৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট, ৪টা ক্লোপিডোগ্রেল ৭৫ মিলিগ্রাম ও একটা নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট ও অ্যাটর্ভাস্ট্যাটিন ট্যাবলেট পানিতে মিশিয়ে কিংবা রোগীকে দিয়ে চিবিয়ে খাইয়ে দিতে হবে এবং সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

৩. প্যানিক অ্যাটাকজনিত বুকে ব্যথা

সাধারণত ৪০ বছর বয়সের নিচের দিকে লোকদের প্যানিক অ্যাটাক বেশি দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে রোগীর পূর্ব থেকে হাই প্রেশার কিংবা অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের কোনো রেকর্ড থাকে না। যেসব মানুষ অতিমাত্রায় দুঃশ্চিন্ত করে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভয়ে থাকে। যেমন- পরীক্ষা ভীতি, জীবন নিয়ে ভয়ভীতি- তাদের ক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাক দেখা যায়। হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হবে। মনে হবে যে, বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। রোগী বলবে কিংবা তার কাছে মনে হবে- একটু পর সে মরে যাচ্ছে। প্যানিক অ্যাটাকের রোগীর কাছে খুব মৃত্যুভয় কাজ করবে এবং তার হাতে-পায়ে কাঁপুনি আসতে পারে, বুক ধড়পড় করবে। ইসিজি করলে নরমাল রিপোর্ট আসবে।

করণীয়

রোগীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে তাকে অভয় দেওয়া এবং সে সুস্থ হয়ে যাবে নিশ্চয়তা দেওয়া। যেহেতু এটা একটা মানসিক রোগ তাই পরবর্তীতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।

৪. গ্যাস্ট্রাটিস বা অ্যাসিডিটিজনিত বুকে ব্যথা

এক্ষেত্রে ব্যথা বুকের বাম পাশে না হয়ে বুকের উপরিভাগে ব্যথা হবে। ব্যথার মধ্যে একটা জ্বালাপোড়া ভাব অনুভব হবে। খাবারের পরে ব্যথা বেড়ে যাবে, খাবারের সময় একটা প্রতিবন্ধকতা মনে হবে। বমিবমি ভাব হতে পারে। সাধারণত হঠাৎ করে রোজা রাখলে কিংবা খাবারে অনিয়মিত ভাব থাকলে কিংবা অত্যাধিক ঝাল খাবার কিংবা তৈলাক্ত খাবার খেলে গ্যাস্ট্রাটিস হয়ে বুকে ব্যথা হতে পারে।

হার্টের ব্যথায় যেমন বুক চিনচিন করে কিংবা ব্যথা হাতের বাহু ও ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ে, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা এমন হয় না। কারও কারও ক্ষেত্রে মনে হবে, তার পেট-পিঠ দুটাই ব্যথায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে বমি হচ্ছে। আবার কারও কারও ঢেকুর আসবে। হার্টের ব্যথা যেমন সাধারণ ৪০ বছরের পরে শুরু হয়, সেক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রাটিসের ব্যাথে যে কোনো বয়সেই হতে পারে। গ্যাস্ট্রাটিসের রোগীর হাই প্রেশার থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। তবে হৃদরোগের রোগীর হাই প্রেশার কিংবা রক্তে অতিরক্তি কোলেস্টেরলের ইতিহাস থাকবে।

করণীয়

গ্যাস্ট্রাটিসজনিত বুক ব্যথা সাধারণত অ্যান্টাসিড জাতীয় সিরাপ যথা অ্যান্টাসিড প্লাস সিরাপ খেলে কমে যায়। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। কারণ, অনেক সময় যদি গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মুখে খাবার বন্ধ করে শিরাপথে ইঞ্জেকশন/স্যালাইনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হতে পারে।