প্রেগন্যান্সি কিন্তু পেটে বাচ্চা নেই, কী অদ্ভূতুরে কান্ড!

প্রেগন্যান্সি কিন্তু পেটে বাচ্চা নেই, কী অদ্ভূতুরে কান্ড!

প্রেগন্যান্সী
ডা. ছাবিকুন নাহার - সংগৃহীত

সিজার করার পর দেখা যায় যে, বাচ্চা পেটে নাই। কী আচানক ঘটনা! তাহলে বাচ্চা গেলো কই?

গত তিন-চার দিন যাবৎ পাবনার এমন একটা ঘটনায় নেট দুনিয়া বেশ উত্তাল। নিউজ পাল্টা নিউজে নিউজফিড সরগরম। গরমের মাত্রা ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়িয়ে দিচ্ছে তুমিনলবাসী মানে ইউটিউবার গোষ্ঠী। এদের তো ঈদ লেগে গেছে অবস্থা। ভাইরে ভাই এরা পারেও। ঘন্টায় ঘন্টায় ব্রেকিং নিউজ!

অনেকেই ইনবক্সে লিংক দিয়ে জানতে চেয়েছেন, এমনটা কি হতে পারে? এক ডাক্তার মেয়েও ইনবক্স করেছেন, আপা আমি ৩৬ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট। আতংকে আছি। এই সম্পর্কে একটু লিখবেন, প্লিজ!

ঘটনা হলো, লেবারপেইন নিয়ে এক রোগী ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে। যার আগের বাচ্চা সিজার। ক্লিনিক থেকে গাইনি সার্জন কল দেওয়া হয়েছে। রোগীর লেবার পেইন সাথে সিজারিয়ান সেকশনের হিস্ট্রি আছে। ইমার্জেন্সি কেইস, তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করতে হবে। না হলে পেশেন্ট বিপদে পড়ে যাবেন।

এই তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করতে যেয়ে এবং পেশেন্টকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ডাক্তার নিজে বিপদে পড়ে গেলেন। এই জন্যই প্রবাদে বলে, "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!"

ইমার্জেন্সি হোক আর যাই হোক ডাক্তার যদি নিজের সেফটির কথা চিন্তা করে একটিবার ডকুমেন্টস দেখতে চাইতেন কিংবা রোগীর ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন করে দেখতেন, তাহলে তাকে এভাবে কাঁদতে হতো না। এই ঘটনা একটা লেসন। বিশেষ করেপেরিফেরিতে গাইনি চিকিৎসা দিতে যাওয়া ডাক্তারদের জন্য আরো বেশি লেসন।

আমি আগে অনেকবার বলেছি,

মেডিকেল সায়েন্সের পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা অন্যদের কাছে গল্প মনে হবে। শুধু গল্প নয় এক্কেবারে আষাঢ়ে গল্প! এই ঘটনাটিও তেমন একটি ঘটনা।
ডাক্তারী ভাষায় এর নাম ফ্যান্টম প্রেগন্যান্সি বা সিউডোসায়েসিস বা ফলস প্রেগন্যান্সি। এখানে একজন পেশেন্টের প্রেগন্যান্সির সকল ধরনের উপসর্গ থাকবে। যেমন - বমি থেকে পেট বড় হওয়া, বাচ্চার নড়াচড়া এমন কি লেবার পেইন পর্যন্ত থাকবে কিন্তু বাচ্চা থাকবে না।

ইতিহাস নিয়ে জানা যাবে এইধরনের পেশেন্টর হিস্ট্রি থাকবে অনিয়মিত মাসিকের, অনেক দিনের বন্ধ্যাত্বর। নিজের কিংবা পরিবারের চাপ থাকবে ছেলে বাচ্চার। এই পেশেন্টর ও অনিয়মিত মাসিক, বেশি ওজন এবং বন্ধ্যাত্বের হিস্ট্রি আছে এবং সে পিসিওএস নামক এক জটিল রোগে ভুগছেন।

এই প্রেগন্যান্সির হার খুব কম, প্রতি বাইশ হাজারে ১-৬ জন। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক আমি শিউর দিয়ে বলতে পারবো অনেক ডাক্তারও এই জিনিসটি জানেন না। অনেক প্রসূতি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ও হয়তো বা সারাজীবনে এমন একটি কেইস না ও পেতে পারেন। যদিও আমি আমার সতেরো বছরের ডাক্তারি লাইফে একটিমাত্র এমন পেশেন্ট পেয়েছি। সে গল্প পরে হবে। সতেরো বছরের গাইনি প্রেক্টিসে যদি একজন মাত্র ফ্যান্টম প্রেগন্যান্সির কেইস পাই সেই ধরনের কেইস অন্য ডিসিপ্লিনের কেউ না পেলে কিংবা জনগন এই ব্যপারে না জানলে খুব বেশি বলার কিছু নেই। এটা তেমন বিগ ডিলও নয়।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, বাচ্চা পেটে নাই অথচ মা মনে করেন তিনি প্রেগন্যান্ট এবং প্রেগন্যান্সির সব ধরনের উপসর্গ ও তার থাকবে, কেনো এমন হয়? ব্যাখ্যা কি?
সুন্দর প্রশ্ন এবং ভ্যালিড প্রশ্ন। সমস্যা হচ্ছে, সহজ প্রশ্নের উত্তর সবসময় সহজ হয় না। জটিল থেকে জটিলতর হয়। জটিল কিছু শোনার জন্য তৈরি আছেন তো? শোনেন তাহলে।

মানুষের মনোজাগতিক কেন্দ্র এবং ইচ্ছা এতোই প্রবল হতে পারে যে, শুধুমাত্র ইচ্ছের জোড়ে একজন নারী তার মাসিক বন্ধ করে দিতে পারে। অর্থাৎ সে যদি ইনটেন্স ইচ্ছে পোষণ করে যে, সে প্রেগন্যান্ট হবে এবং প্রেগন্যান্সির জন্য ডাইহার্ট হয়, দীর্ঘ বন্ধ্যাত্ব নিয়ে স্ট্রেসের ভেতর দিয়ে যায় তাহলে তার পিরিয়ড বা
মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং যাবে। আর কে না জানে, প্রেগন্যান্সির প্রথম উপসর্গ মাসিক বন্ধ থাকা? পরপর কয়েকমাস মাসিক না হলে পেটে মেদ জমবে। পেট বড় হতে থাকবে।

ইতোমধ্যে তার প্রেগন্যান্সির ব্যপারটি প্রিয়জনরা জেনে গেছে। দীর্ঘ বঞ্চনার জীবন পেরিয়ে স্বামী, শাশুড়ি, পরিবার, সমাজ থেকে সে পেম্পারিং পাওয়া শুরু করেছে। অনেক আকাঙ্ক্ষার ভ্যালুয়েবল বাচ্চা ফলে তাকে খুব সব ধরনের কায়িক শ্রম থেকে দূরে রাখা হয়। একদিকে যত্নআত্তি ভালো খাবারদাবার আরেকদিকে পরিশ্রমের কাজ থেকে দূরে থাকা। ফলাফল তার ওজন আরো বেশি বেড়ে যায়। ওজন বাড়তে থাকা প্রেগন্যান্সির ধারণাকে আরো বেশি শক্ত করে।

এদিকে বেশি ওজনের রোগীর ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন করা একটু ডিফিকাল্ট। ফলে প্রফেশনালরাও ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। তাদের আলট্রাসাউন্ড এর সাহায্য নিতে হয়। আলট্রাসাউন্ড করলে দেখা যায়, পেটে কোনো বাচ্চা নেই।
এই রোগীরা আসলে জানে তাদের যে বাচ্চা নেই, ধরা পড়ার ভয়ে অনেকে তাই ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না, পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চায় না। কেননা দীর্ঘ বঞ্চনার পর হোক মিথ্যা তবুও এই প্রেগন্যান্সির উসিলায় তার জীবনে একটু আদর সোহাগ এসেছে। সে যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এটা সমাজ, সংসার মেনে নিয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি এটা শেষ হয়ে যাক, কে চায় বলুন?

উক্ত রোগীর ক্ষেত্রে আমরা ভালো ভাবে খেয়াল করলে দেখতে পাবো, তার কোনো ভ্যালিড আল্ট্রাসাউন্ড নাই, যেটা বাচ্চা আছে প্রমাণ করে। বরং তাকে নাকি বলা হয়েছিলো বাচ্চা নেই। কনফার্ম করার জন্য প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে। সে করেনি।
আটমাসের সময় ডাক্তার দেখাতে এসে ডাক্তার না দেখিয়েই স্বামীকে বলেছেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন। তার ছেলে বাচ্চা হবে। স্বামী যখন ঔষধ কিনতে প্রেসক্রিপশন চেয়েছেন, তখন বলেছেন ডাক্তার বলেছেন, আট মাস ঔষধ খাওনি এখন আর খাওয়া লাগবে না। এবং খটকা আরেকটু জোড়ালো হয়েছে, তাদের জোর দিয়ে বলা, ছেলে বাচ্চার কথা। আগে একটি মেয়ে বাচ্চা আছে এবার একটি ছেলে বাচ্চার স্বপ্ন দোষের কিছু নয়। এসব তথ্য সবই উক্ত ঘটনার সংবাদ সম্মেলন থেকে পাওয়া।
একজন ডাক্তার হয়ে দায় নিয়েই বলছি, উক্ত ডাক্তারের ভুল ছিলো কোনো কিছু না জেনে, না দেখে অপারেশন করতে রাজি হওয়া। হোক রোগী ইমার্জেন্সি কন্ডিশনের। হোক রোগী মরো মরো। নিজের সেফটির ব্যপারও তো দেখতে হবে। মানতে হবে প্রোটোকল কি বলে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন না করে, কনফার্ম না হয়ে অস্ত্রোপচারের কথা বলে না। না মানে না। নো নেভার এভার।

এই পৃথিবী, এই সমাজ কখনো একজন রোগী বাঁচানোর জন্য একজন ডাক্তারের মনের ভেতরের কাঁপুনিটা টের পায় না। পাওয়া সম্ভব নয়। পেলে একটু খোঁজ নিতো ঘটনা কি? ঘটনার ভেতরের ঘটনাই বা কি। সব তো হাতের কাছেই। ফ্যান্টম প্রেগন্যান্সি লিখে একটু সার্চ দিলেই তো হয়ে যায়। দিবেন কি?
©
ডা. ছাবিকুন নাহার
এমবিবিএস ( ঢাকা), বিসিএস ( স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস ( অবস & গাইনী)
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ইনফার্টিলিটি
স্ত্রী, প্রসূতি ও গাইনীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।