হার না মানা এক মেডিকেল শিক্ষার্থীর গল্প

হার না মানা এক মেডিকেল শিক্ষার্থীর গল্প

শজিমেক
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ২৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম হৃদয় - সংগৃহীত

আমার নাম আরিফুল ইসলাম হৃদয়। বাড়ি বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ।

ভবিষ্যৎ পরিচয়: একজন ডাক্তার

বর্তমান পরিচয়: একজন চা বিক্রেতা

চলুন গল্প শুরু করি,

এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, ছোটবেলা থেকে বেশ ভালো ছাত্র ছিলাম।

আব্বার ছিল চায়ের দোকান। মাঝে কিছুদিন সুতার ব্যবসা ছিল... তবে সেটাতে লস খেয়ে আবার চায়ের দোকানেই ফিরে যান তিনি।

ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম, পাশাপাশি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম। সবমিলিয়ে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

আমার যুদ্ধের শুরুটা হয় ক্লাস এইট থেকে। আব্বার ঘাড়ে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ব্যবসায় লস খেয়ে আব্বা শুধুমাত্র চায়ের দোকানের আয় দিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে পারছিলেন না। ওই অবস্থায় আমার পড়াশোনা যেন "বিলাসিতা"।

তাও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার প্রতিজ্ঞা ছিল মনে। কখনই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার কথা চিন্তা করিনি।

কোচিংয়ের টাকা দেয়ার সামর্থ্য ছিল না আব্বার। আমার বৃত্তির টাকা আর আম্মা মেশিনে সুতা পেঁচিয়ে যে টাকা আয় করতেন- সেটা দিয়ে কোচিংয়ের খরচ চালাতাম।

ক্লাস নাইনে উঠতেই বড়বোনের বিয়ের সময় চলে আসে। আব্বার ঋণের অংক আরও বাড়তে থাকে।

এবার আমার যুদ্ধ শুরু হয় ক্ষুধার সাথে।

বাসায় ২৪ ঘন্টা অশান্তি বিরাজ করত। বাবা মায়ের ঝগড়া সহ্য করতে পারতাম না। তাই সকাল ৭ টায় বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। কোচিং আর স্কুল শেষে বিকাল ৫ টায় বাসায় ফিরতাম। ভাত খেয়েই খেলার মাঠে খেলতে চলে যেতাম। মাঝে মাঝে বাসায় এসে দেখতাম ভাত নাই।

তখন বন্ধুদের বাসায় যেয়ে খাওয়া-দাওয়া করতাম।

বিশ্বাস করেন, ক্ষুধার জ্বালার মতো ভয়ঙ্কর কষ্ট আর কোনকিছুতে নাই।

এভাবেই স্কুলের গন্ডি পার হল। SSC তে গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম। আমার স্বপ্নের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়।

রেজাল্ট অনুযায়ী ঢাকা কলেজে চান্স পেলাম।

আর আমার জেদ ছিল, ভালো কলেজেই পড়ব। ঢাকাতেই পড়ব। তাই এতো অভাব সত্ত্বেও ঢাকায় ভর্তি হলাম।

এখানে ত্রাণকর্তা ছিলেন আমার ফুফাত ভাই... হাবিব ভাই। তিনিই কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। হোস্টেলে সিট পাওয়ার পর্যন্ত দেড়মাস তার বাসাতেই ছিলাম।
আশেপাশের মানুষ অনেক কথা শোনাত। বলত "খাওয়ার টাকা নাই, আবার ছেলেকে ঢাকায় পড়াচ্ছে!!!"

এগুলো দেখে আমার জেদ আরও বেড়ে যেত।

বাবা প্রতি দশদিন পর পর ৫০০ টাকা পাঠাতেন। আমার হোস্টেলে দুপুরে আর রাতে খাওয়ার মিল ছিল ২৫+২৫=৫০ টাকা। এই ৫০০ টাকার পুরোটাই আমার দুপুরে আর রাতে খাওয়ার খরচের পেছনে চলে যেত। সকালে মাঝে মাঝে বন্ধুরা খাওয়াতো।

আমার যদি কখনও কোনকিছু কিনতে ইচ্ছা করতো, না খেয়ে টাকা বাঁচাতাম। তারপর সেটা দিয়ে কেনাকাটা করতাম।

পরটা-ডিম আমার খুব পছন্দের খাবার। মাঝে মাঝেই শুক্রবারে দুপুরে না খেয়ে, টাকা বাঁচিয়ে.. রাতে পরটা-ডাল-ডিমভাজি কিনে খেতাম হোটেল থেকে।

বন্ধুরা প্রাইভেট পড়ত বিভিন্ন স্যারের কাছে। আমার সেই সামর্থ্য ছিল না। কারণ এক সাবজেক্ট পড়তেই ১৫০০ টাকা লাগতো! ওটা তো আমার খাওয়ার খরচ।
নিজে নিজেই পড়াশোনা চালিয়েছি।

আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়, HSC তেও এ-প্লাস পেয়ে পাশ করলাম।

ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও... আমি ম্যাথ খুব একটা ভালো পারতাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম মেডিকেল কোচিং করব।

এবার কোচিং এ ভর্তির পালা।

কিন্তু কোচিংএ ভর্তি হওয়ার জন্য ১৬ হাজার টাকা লাগবে! কই পাব?

টাকা জোগাড় করলেন আম্মা। সুতা প্যাঁচানোর মেশিন বিক্রি করে পাওয়া গেল ৬ হাজার টাকা। আর বাকি ১০ হাজার ধার করা হল।

একমাস দেরিতে ভর্তি হলাম কোচিংয়ে। সবার যখন অর্ধেক বই শেষ.. আমার কেবল শুরু!

তিন জায়গায় ভর্তি ফর্ম তুলি। সব জায়গায় ফর্ম তোলার টাকা ছিল না।
* মেডিকেল
* ঢাবি-ক
* জাবি-ঘ

জাহাঙ্গীর নগরে ১৯২ তম হই, আর শজিমেকে চান্স পেয়ে যাই।

মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর মানুষের সেই সব কথার জবাব দেয়া হয়ে যায় আপনা আপনিই।

তবে ক্ষুধার সাথে যুদ্ধটা আমার এখনও। আব্বা এখনও সেই দশদিন পর পর ৫০০ টাকা করে পাঠায়। আমি এখনও টাকা বাঁচিয়ে চলি। মেডিকেল জীবনের সেরা প্রাপ্তি আমার ব্যাচের কিছু বন্ধু আর সিনিয়র জুনিয়র। ক্যাম্পাস খোলা থাকলে মনে হয় না আমি এতো বেশি স্ট্রাগল করে উঠে এসেছি.. এতো কান্নাকে পেছনে ফেলে এসেছি। মনে হয় আমিও সবার মতো হাসিখুশি একজন মানুষ। মনে হয় আমিও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা ডাঃ সাকলায়েন রাসেল (ভাস্কুলার সার্জন, IMC) ভাই এর প্রতি। তিনি আমাকে ফার্স্ট ইয়ারে প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়েছেন। আমাকে মানসিক ও আর্থিক নির্ভরতা দিয়েছেন।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ'র কৃপা, মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া না থাকলে আমার এই স্বপ্ন কখনও পূরণ হতো না।

আর হ্যাঁ, আমি আমার শেকড়কে ভুলে যাইনি। এখনও আব্বার দোকানে যাই। চা বানাই। দোকানদারি করি।

চা-ওয়ালা পরিচয় দিতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। বরং আমি গর্ববোধ করি নিজেকে নিয়ে। গর্ববোধ করি আমার আম্মা আর আব্বার জন্য।

আর হ্যাঁ,
এখনও স্বপ্ন দেখি..

স্বপ্ন দেখি.. আব্বাকে আর একদিন চা বানাতে হবে না। তার সব ধার দেনা আমি শোধ করে দেব।

স্বপ্ন দেখি.. আমার আব্বা-আম্মাকে নিয়ে ভালো একটা বাসায় থাকব।

স্বপ্ন দেখি আমার ছোটবোনটা পড়াশোনা করে একদিন অনেক বড় হবে। তার বিয়ের সময় আর কোন ধার দেনা থাকবে না।

স্বপ্ন দেখি.. মানুষের সেবা করার। মানুষের দোয়া আর ভালোবাসাতেই তো এতোদূর আসতে পেরেছি। সেগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে না?

-আরিফুল ইসলাম হৃদয়
২৮ তম ব্যাচ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ।