কর্নিয়া কী? যেভাবে চক্ষু সংযোজন করা হয়

কর্নিয়া কী? যেভাবে চক্ষু সংযোজন করা হয়

প্রতীকী ছবি

চোখের একদম সামনের দিকে স্বচ্ছ অংশ হলো কর্নিয়া। অনেক সময় আঘাত লেগে বা জীবাণুর সংক্রমণে কর্নিয়াতে আলসার হতে পারে। দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নিলে স্থায়ীভাবে কর্নিয়া ঘোলা হয়ে যেতে পারে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে ওষুধের দ্বারা এর চিকিৎসা সম্ভব নয় বলেও চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ডা. মো. আব্দুল কাদেরের সাক্ষাৎগ্রহণের অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন ডা. কে জান্নাত

কর্নিয়া কী এবং এর কাজ কী ?

আইরিশ এবং পিউপিলকে ঢেকে রাখে কর্নিয়া। পিউপিল হলো আইরিশের মাঝের ছিদ্রটি যা ছানিমুক্ত চোখে কালচে দেখায় এবং ছানিযুক্ত চোখে ছানির পরিপক্বতার মাত্রা অনুসারে ধূসর বা সাদা দেখায়। স্বাভাবিক দৃষ্টির জন্য কর্নিয়া স্বচ্ছ থাকা আবশ্যক।

কর্নিয়াতে কোন রক্তনালী না থাকাটা এর স্বচ্ছ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। স্বচ্ছতার কারণে এর ভেতর দিয়ে আলো চোখের ভেতরে প্রবেশ করে এবং পেছনের রেটিনার ওপর পড়তে পারে। তখন আমরা কোন বস্তুকে দেখতে পাই। কর্নিয়া আলোক রশ্মি প্রবেশে সাহায্য করে।

কর্নিয়া কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে- এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল কাদের ডক্টর টিভিকে বলেন, চোখের একটা অংশ হচ্ছে কর্নিয়া। চোখের বাইরে সামনে যে শক্ত আবরণ আছে তার একদম সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মত অংশটুকুই হলো কর্নিয়া।

অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল কাদের বলেন, খালি চোখে কর্নিয়া দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ এটি হলো ক্রিস্টাল কেয়ার। এর কোন রঙ নাই। এটি একদম পরিষ্কার। এর ভেতর দিয়ে সমস্ত আলো চোখে প্রবেশ করে। চোখের দিকে তাকালে যে অংশটি দেখতে পাওয়া যায় তাতে আইরিশের কালারটাই দেখা যায়।

তিনি বলেন, কর্নিয়াটা খুবই স্বচ্ছ তাই আমরা তার পেছনের অংশটা দেখতে পাই। কর্নিয়ার কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, চোখের ভেতরে আলো প্রবেশ করে দৃষ্টি বা দৃষ্টির আবহ তৈরি করা। আমাদের চোখের বা দেখার পাওয়ার ৭০ ভাগ কর্নিয়া ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় আর অবশিষ্ট ৩০ ভাগ অন্যান্য অংশ ধারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

কর্নিয়াতে কী কী রোগ হয় ?

কর্নিয়াতে যেসব রোগ হয় তা নিয়ে বলতে গিয়ে ডা. আব্দুল কাদের বলেন, অন্যান্য রোগের মত কর্নিয়াতেও একইরকম রোগ হয়। তার মধ্যে কিছু রোগ জন্মগত আর কিছু রোগ জন্মের পর হয়। কর্নিয়ার নরমাল একটা সাইজ বা আকৃতি আছে। দেখা গেল কর্নিয়াটা যেটুকু সাইজে থাকার কথা ছিল তার থেকে ছোট বা বড় হয়ে গল আবার দেখা গেল কর্নিয়ার ক্রিস্টাল যেখানে স্বচ্ছ থাকার কথা সেখানে ঘোলা হয়ে গেল।

আবার অনেক সময় কর্নিয়াতে কিছু টিউমার হতে পারে যাকে আমরা ডার্মাইট বলে থাকি। এগুলো হলো জন্মগত কিছু রোগ। আবার কিছু কিছু জন্মের পর হয়ে থাকে যাকে আমরা ক্যারাটাইটি বা প্রদাহ বা কর্নিয়া আলসার বলে থাকি। তাছাড়া কিছু ডিস্ট্রপি কন্ডিশন থাকতে পারে। দেখা গেল কর্নিয়াটা বাঁকা হয়ে গেল, স্বাভাবিক আকৃতি থেকে অস্বাভাবিক হয়ে গেল।

আবার অনেক সময় কিছু ডিস্ট্রপি বা ডিজেনারেশনও হতে পারে। তাছাড়া কিছু কর্নিয়াল ডিবাইর, কর্নিয়াল ইনট্রেপ, ইসিলিয়ার ডিওপ্রাস এ সমস্ত কিছু টিউমার হতে পারে।


কর্নিয়াল ট্রান্সপারেন্সি লস হওয়ার কারণ

প্রথমত অপারেশনের কারণে কর্নিয়াল ট্রান্সপারেন্সি লস হতে পারে বলে জানান ডা. আব্দুল কাদের। তবে বেশি লস হতে পারে যদি কর্নিয়াতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ঘা হয়, আলসার হয় অথবা কর্নিয়াতে পানি জমে থাকে।

তিনি বলেন, ধরুন- অপারেশন করতে গিয়ে যদি আমি কর্নিয়াতে আঘাত করি অর্থাৎ কর্নিয়াতে অ্যান্ডোথেলিয়ামে আঘাত করি বা ধ্বংস করে ফেলি তাহলে কর্নিয়াতে পানি জমে যেতে পারে আর কর্নিয়া ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে মূলত কর্নিয়াল ট্রান্সপারেন্সি লস হতে পারে।

চক্ষু বা কর্নিয়া সংযোজন কীভাবে করা হয়?

ডা. আব্দুল কাদের জানান, চক্ষু সংযোজন হলো কর্নিয়া প্রতিস্থাপন। মানুষের কর্নিয়া যদি ঘোলাটে হয়ে যায় আর ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার কারণ যদি চোখে না দেখে অথবা এমন কোন সমস্যা হলো যার কারণে সে প্রতিনিয়ত ব্যথা অনুভব করছে বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তখন আমরা চোখের মণি পাল্টাই। আর মানুষ মারা গেলে আমরা তার চোখ গ্রহণ করি যদি সে মারা যাওয়ার আগে তার কর্নিয়াটা মানবতার জন্য দান করে যায়।

তিনি বলেন, কোন মৃতের পরিবার যদি বলে তার কর্নিয়াটা নিতে তখন আমরা তা নিই। তাছাড়া আমাদের দেশে যেহেতু কর্নিয়া সংগ্রহটা কম তাই আমরা অ্যামেরিকা, নেপাল আর শ্রীলঙ্কা থেকে কর্নিয়া নিয়ে আসি। সর্বশেষ আমরা অসুস্থ কর্নিয়াটা কেটে ফেলে দিয়ে নতুন কর্নিয়াটা স্থাপন করি। এভাবেই আমরা চক্ষু সংযোজন করে থাকি।

কর্নিয়া যেভাবে সংগ্রহ করা হয়

বাংলাদেশে অসংখ্য কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ থাকলেও দেশের মানুষকে ডাক্তাররা কর্নিয়া দান করাতে সচেতন করতে পারেনি বলে মত দিয়েছেন ডা. আব্দুল কাদের। তাই প্রথমেই কর্নিয়া-দানে মানুষকে সচেতন করার এবং ইচ্ছা আর আগ্রহ বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষু দান করে থাকে তাহলে ডাক্তাররা বিভিন্ন আই ব্যাংকের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে। তবে যিনি চক্ষু দিবেন তাদেরকে ওইসব আই ব্যাংকের সাথে একটা চুক্তি করতে হবে আর পুরো বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে রাখতে হবে যাতে তারা মরণের পর তার চক্ষু দান করতে সহযোগিতা করতে পারে। এখানে চক্ষু বলতে শুধু কর্নিয়াটা সংগ্রহ করা হয়। পরে তা অপারেশন না হওয়া পর্যন্ত আই ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়।

ডা. আব্দুল কাদের জানান, আই ব্যাংকে কর্নিয়া সর্বোচ্চ সাত থেকে আট ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তবে যদি চোখের কোয়ালিটি ভাল হয় অথবা ডেড-বডি হিমাগারে রাখা হয় তাহলে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আর সেরকম একটি আই ব্যাংক হলো 'সন্ধানী আই ব্যাংক'।

কর্নিয়া সংযোজন সবার চোখে করা যায় কিনা ?

ডা. আব্দুল কাদের বলেন, আমরা সবার চোখে কর্নিয়া সংযোজন করতে পারি। বিশেষ করে যাদের চোখের কর্নিয়া অসুস্থ তাদের সবার চোখে কর্নিয়া সংযোজন করা যায়। তবে যাদের খুব সমস্যা অর্থাৎ বাচ্চা আর বৃদ্ধদের রেজাল্টটা খুব একটা ভাল থাকে না। তার কারণ হলো- বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তাদের ইমিউনিটিটা কম থাকে আর অন্যজনের চোখ গ্রহণ করার ক্ষমতাটা কম থাকে। তাই তাদের ক্ষেত্রে কর্নিয়া সংযোজন কঠিন হয়।

আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একটু কঠিন হয়। কারণ বাচ্চাদের কর্নিয়াটা অপারেশন করার পর চিকিৎসা দেওয়াটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে এবং তাদের কর্নিয়াটা খুব ছোট থাকে। তাছাড়া আমরা যদি অ্যাডল্ট কর্নিয়া লাগাই তাহলে সামঞ্জস্য হতে একটু সমস্যা হয়। তাছাড়া সবার চোখে কর্নিয়া সংযোজন করা যায়।


→ অনুষ্ঠানের পুরো ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন