- ডা. তানিয়া রহমান মিতুল
- ২৮ মার্চ ২০২১, ০৫:৩৭
বেশি বয়সে মা হওয়ায় যত ঝুঁকি
বেশি বয়সে মা হওয়ায় যত ঝুঁকি
মা হওয়া প্রত্যেক নারীর জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। বিভিন্ন কারণে গর্ভধারণ নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। বিষয়টি নিয়ে ডক্টর টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন সরকারি কুয়েত মৈত্রি হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অব্স বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. নাদিরা হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. তানিয়া রহমান মিতুল।
ডক্টর টিভি: ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা কী?
ডা. নাদিরা হক: মা হওয়া একজন নারীর স্বপ্ন। কিন্তু কোনো কারণে যদি সেই গর্ভাধারণ মায়ের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়, তাহলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা বলতে পারি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের দেশে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গর্ভধারণ ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। মায়েদের ব্যক্তিগত কিছু ফ্যাক্টর, পূর্বের সন্তান প্রসবের সময় হওয়া জটিলতা, গর্ভাবস্থায় হওয়া কোনো রোগের কারণেও হতে পারে।
এছাড়া পূর্বের সার্জিক্যাল ইতিহাস, গর্ভাবস্থায় কোনো অসুস্থতার কারণেও হতে পারে। এর বাইরে বয়সের কিছু কারণও আছে। আঠারো বছর বা এর কম বয়সে কোনো নারী গর্ভধারণ করতে গেলে কিছু জটিলতা হতে পারে। গর্ভকালীন সময় ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
থাইরয়েড জাতীয় সমস্যা, গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা, জরায়ু টিউমারের কারণে সার্জারি এবং একাধিক গর্ভপাতের ইতিহাস থাকেলে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। মৃত বা ত্রুটিপূর্ণ শিশু জন্ম দিয়ে থাকলে। আগের সন্তান প্রসবের সময় যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে বা গর্ভফুল আটকে থাকে। গর্ভে শিশুর অবস্থান অস্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে। গর্ভকালীন হটাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে, গর্ভকালিন খিঁচুনি দেখা দিলে ঝুঁকি তৈরি হয়।
ডক্টর টিভি: গর্ভধারণপূর্ব কাউন্সিলিং কী এর প্রয়োজন কতটুকু?
ডা. নাদিরা হক: গর্ভধারণপূর্ব কাউন্সিলিং পৃথিবীর অন্যান দেশে অনেক জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও কাউন্সিলিং শুরু হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। কোনো দম্পতি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনার সময় একজন গাইনোকোলোজিস্ট বা প্রসূতি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়াকে কাউন্সিলিং বলা হয়। এসময় দেখা হয় তিনি শারীরিক বা মানসিকভাবে গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত আছেন কি না।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ রোধে গর্ভধারণপূর্ব কউন্সিলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারাণ অনেকেই জানে না যে, তার কোনো রোগ আছে কি না। এই অবস্থায় গর্ভধারণ ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ডায়েবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এনে গর্ভধারণ করলে ঝুঁকি কমে যায়। ত্রুটিযুক্ত শিশু জন্মের ঝুঁকি কমে যায়। কিছু ওষুধ গর্ভাবস্থায় নেওয়া যায় না সেই রোগগুলো আগেই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এছাড়া হার্টের সমস্যা থাকলে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পর গর্ভাধারণ অনেকটাই ঝুঁকি কমায়।
ডক্টর টিভি: গর্ভাবস্থায় চেকআপ কী ? সব মায়েদের চেকআপ কি একই ?
ডা. নাদিরা হক: গর্ভাবস্থায় প্রত্যেক মায়ের চেকআপ করাতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চেকআপ আলাদা হয়ে থাকে।
সাধারণ মায়েদের ক্ষেত্রে ২৮ সপ্তাহ পর্য়ন্ত প্রতিমাসে একবার, ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে দুই বার এবং ৩৬ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকআপে আসতে বলা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারবার চেকআপের আওতায় আসতে হবে।
একজন মা গর্ভবতী হওয়ার ১৬ সপ্তাহের মধ্যে একবার চেকআপ করাবেন। দ্বিতীয় চেকআপ ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে এবং তৃতীয় চেকআপ ৩২ সপ্তাহের মধ্যে করাবেন। এছাড়াও ৩৬ সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় চেকআপের আওতায় আসতে হবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ময়েদের ক্ষেত্রে আরও বেশি চেকআপ দরকার।
ডক্টর টিভি: গর্ভধারনের জন্য বয়সসীমা কত?
ডা. নাদিরা হক: একজন নারীর গর্ভধারনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ২০-৩০ বছর। যদিও ৩৫ বছর পর্যন্ত গর্ভধারণ নিরাপদ। তবে ১৮ বছরের আগে গর্ভধারণ কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ মায়ের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের আগে গর্ভধারনে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এসময় শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি তৈরি থাকে না। অনেকক্ষেত্রেই মায়েদের প্রথম গর্ভধারনটি নষ্ট করতে হয়। কম বয়সে গর্ভধারনে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বা খিঁচুনির মতো সমস্যাও হতে পারে। অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও কম বয়সে গর্ভধারনে সন্তান প্রসব পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতায় পড়েতে হয় মায়েদের।
ডক্টর টিভি: বেশি বয়সে গর্ভধারনের ঝুঁকিগুলো কী?
ডা. নাদিরা হক: সাধারণত ৩০ বছর বয়সের পর গর্ভধারন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বর্তমানে মেয়েদের বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে সবচেয়ে ভালো সময়ে গর্ভধারন করতে পারছেন না। বেশি বয়সে গর্ভধারন করতে গিয়ে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়। যেমন, গর্ভকালিন উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, এক্লাম্পসিয়া, ডায়াবেটিস সমস্যা। এছাড়াও ৩৫ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ করলে ত্রুটিযুক্ত শিশু জন্মের আশংকা বেশি থাকে, সিজারিয়ানের প্রয়োজন বেশি হয়।
ডক্টর টিভি: গর্ভধারনের ক্ষেত্রে স্থুলতার (ওবেসিটি) কোনো প্রভাব আছে ?
ডক্টর নাদিরা হক: গর্ভবতী মায়ের ওজন বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। বিষয়টি নির্ভর করে মায়ের গর্ভধারনের আগে ওজন কেমন ছিলো তার ওপর। এছাড়াও বিএমআই বা উচ্চতার অনুপাতে ওজন কেমন তার ওপর।
একজন স্বাভাবিক ওজনের মা গর্ভধারনের পর ১২ থেকে ১৬ কেজি ওজন বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। যদি কম ওজনের কোনো মা গর্ভধারণ করেন তাহলে তার ১৩ থেকে ১৮ কেজি ওজন বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়।
স্বাভাবিক বিএমআই (বডি মাস্ট ইনডেক্স) ১৮ থেকে ২৩ দশমিক পাঁচ পর্যন্ত। যারা বেশি ওজনের অর্থাৎ যাদের বিএমআই ২৪ থেকে ২৯ পর্যন্ত তাদের ক্ষেত্রে ৭ থেকে ১১ কেজন ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক। বিএমআই ৩০ এর উপরে হলে ৪ থেকে ৭ কেজি ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক বলে ধরা হয়।
স্থুলতা নিয়ে গর্ভধারণ করলে শিশুর হার্টের সমস্যা হতে পরে। এছাড়া সিজারিয়ানের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সিজারিয়ানের সময় এনেসথেসিয়ায়ও সমস্যা হতে পারে।