দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

দাঁতের মাড়ি
দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া সমস্যা (ইনেসেটে ডা. অনুপম পোদ্দার) - ফাইল ছবি

মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া আমাদের দেশের জনসাধারণের একটি প্রধান সমস্যা। অনেকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মুখে রক্ত দেখতে পায়, অনেকে মনে করে ব্রাশের সাথে রক্ত আসে আবার অনেকের শক্ত খাবার খেলে খাবারের গায়ে রক্ত দেখতে পায়, আবার অনেকের দাঁতের গোড়া দিয়ে অনবরত রক্ত পড়তে থাকে।

স্থানীয় ও শারীরিক অন্যান্য রোগের কারণে দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে।

১. স্থানীয় কারণ: মাড়িতে ডেন্টাল প্লাক ও দন্তপাথুরী জমা থাকার কারণে মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, ফলে মাড়ি ফুলে যায়। দাঁতের সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এই সময়ে দাঁত ব্রাশ করলে বা শক্ত কোনো খাবার খেলে অথবা সামান্য আঘাতেই মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় মাড়ির রোগ । যার দুটি স্তর রয়েছে, প্রথম স্তরটি হচ্ছে মাড়ির প্রদাহ
এবং দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে পেরিওডন্টাইটিস।


২. শারীরিক অন্যান্য রোগ:
i.কারো যদি ব্লাড ক্যান্সার থাকে (লিউকোমিয়া),
ii.লিভার সমস্যা থাকে,
iii.যদি রক্তের প্লেইটলেট বা হিমোগ্লোবিন কম থাকে যেমন ব্লাড ডিজঅর্ডার বা রক্তের ব্যাধি থাকে তাদের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে।
iv. সেইসঙ্গে যারা হৃদরোগের কারণে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খান,
iv.রক্ত পাতলা রাখার জন্য ওষুধ খান,
V.অ্যাসপিরিন অথবা ডিসপিরিন বা ক্লোপিড জাতীয় ওষুধ খান তাদের এটি হতে পারে।
vi.গর্ভকালীন মায়েদের এক ধরনের হরমোনের কারণে মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে।


সমাধানের উপায়:

মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণকে খুব সহজভাবে দেখলে চলবে না। এর জন্য রোগীর ইতিহাস, বিভিন্ন রোগের উপস্থিতি ও ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে দেখাতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া যারা ধূমপান করেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাও ঝুঁকিপূর্ণ। ধুমপানের কারণে মাড়িতে প্রদাহ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মাড়িতে তীব্র প্রদাহ হয়। ফলে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার লক্ষণ

১. মাড়ি লাল হয়ে যাওয়া ও ফুলে যাওয়া।

২. মাড়ি থেকে দাঁতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

৩. দাঁত ব্রাশ করলে বা শক্ত কোনো খাবার চিবিয়ে খেলে রক্ত বের হওয়া।

৪. অনেক ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠলে মুখে রক্ত দেখা যাওয়া, আবার অনেক ক্ষেত্রে লালার সঙ্গে রক্ত মিশে গিয়ে বিছানায় বালিশেও রক্ত দেখা যাওয়া।

 

নিয়মিত মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার পরেও যদি চিকিৎসা না হয় তবে মাড়ির প্রদাহের কারণে দাঁতের সাথে মাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ধীরে ধীরে দাঁত নড়ে যাওয়া এবং যে কোনো সময় পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া মাড়ির এই প্রদাহের কারণে বিভিন্ন জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া রক্তে মিশে দেহের অন্যতম প্রধান অঙ্গসমূহ যেমন হার্ট বা হৃদযন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে, হৃদরোগ হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মাড়ি থেকে ব্যাকটেরিয়া ভবিষ্যৎ শিশুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, শিশু কম ওজনের হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থেকে ব্লাড সুগার বা শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধে করনীয়:

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধের চিকিৎসা দুই ধরনের।
যদি স্থানীয় কারণে হয়ে থাকে তবে ডেন্টাল প্লাক (দাঁতের ওপর লেগে থাকা খাদ্য কণার শক্ত আবরণ) পরিষ্কার করা। এর জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে ডেন্টাল স্কেলিং। অধুনিক আলট্রাসনিক স্কেলার যন্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকা ডেন্টাল প্লাক বা শক্ত আবরণ পরিষ্কারভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়।

যদি মাড়ি প্রদাহের কারণে ফুলে যায় তবে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরে মাড়ির শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে, যাকে বলা হয় জিনজিভেকটমি বা রুট প্ল্যানিং। এর ফলে মাড়ি পরবর্তীতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে আর রক্তক্ষরণ হওয়ার সুযোগ থাকে না।


দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া প্রতিরোধ

১. মাড়ির রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে প্রতিদিন দুইবেলা সকালে নাস্তার পরে ও রাতে খাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করা।

২. ওপরের পাটি থেকে নিচের পাটি এবং নিচের পাটি থেকে ওপরের পাটি এইভাবে ওপর নিচ বা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। যাতে প্রত্যেকটি দাঁতের বাইরের এবং ভেতরের পাটির প্লাক থেকে খাদ্য কণা পরিষ্কার হয়।

৩. নিয়মিত দাঁত ব্রাশেরেআগে ডেন্টাল ফ্লশ (একজাতীয় সিল্কের পিচ্ছিল সূতা) দিয়ে দুই দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা পরিষ্কার করা এবং একজাতীয় মাউথ ওয়াশ আয়োডিন দিয়ে কুলিকুচি করা।

৪. প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল যেমন- কমলালেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, আমলকি, আমড়া, কলা এবং মাল্টা খেতে হবে। তাছাড়াও প্রতিদিন সালাদ হিসেবে গাজর, টমেটো, শশা, লেবুর রস ইত্যাদি খাওয়া।

৪. ধূমপান বা তামাকজাতীয় খাদ্য বর্জন করা।

৫. ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা (নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধ সেবন)।
৬. অন্যান্য রোগের কারণে হলে ফিজিশিয়ান এর কাছে রেফার্ড করে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।


ডা. অনুপম পোদ্দার
অধ্যক্ষ
খুলনা ডেন্টাল কলেজ


আরও দেখুন: