ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা : জানলে মানলে অনেক সোজা

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী

ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ধানমন্ডি মেডিনোভা ডায়াবেটিস সেন্টার এবং সিটি হাসপাতাল ডায়াবেটিস সেন্টার৷

ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা : জানলে মানলে অনেক সোজা

ডায়াবেটিস
ডা. মোঃ এজাজ বারী চৌধুরী, ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞ - সংগৃহীত

১. রোজায় কোন ঔষধ কখন খাবেনঃ

ডায়াবেটিসের ঔষধ এবং ইনসুলিনঃ 

সকালে নাস্তার আগের ঔষধগুলো- ইফতারের শুরুতে খাবেন এবং ইনসুলিন নিয়েই ইফতার শুরু করবেন৷ এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের মতো ৫ থেকে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা যাবেনা৷ 

© নাস্তার পরের ঔষধ ইফতারের শেষে খাবেন৷

© যাদের রাতের খাবারের আগেও ইনসুলিন নিতে বা ঔষধ খেতে হয়, সেটা তারা সেহরীতে নিবেন এবং খাবার আগের waiting period (ক্ষেত্রবিশেষে ৫ থেকে ৩০ মিনিট) ঠিকই বজায় রাখবেন৷ 


থাইরয়েডের ঔষধঃ 

সেহরীর অন্তত আধা ঘন্টা আগে খাবেন৷

প্রেশারের ঔষধঃ 


© সকালের গুলো সেহরীতে এবং রাতের গুলো ইফতারে খাবেন৷ রোজা শুরুর আগের দিন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাতের ঔষধ খেয়ে নেবেন৷


© তবে Diuretics গ্রুপের ঔষধ যদি আপনার সকালে থাকে, তাহলে এটি ইফতারে খেতে হবে৷ এক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ পূণর্বিন্যাস করে নিবেন৷


© আপনার যদি শুধু রাতে প্রেশারের ঔষধ থাকে, তবে সেটা রাতে আগের সময়েই খাবেন৷


© ঔষধ খেয়ে আপনার প্রেশার যদি ১১০/৭০ বা ১০০/৬৫ থাকে তবে সেহরীতে ঔষধের ডোজ একটু কমানো লাগতে পারে৷ 


# কোলেষ্টেরল এবং হার্টের ঔষধঃ 
© কোলেষ্টেরলের ঔষধ রাতে খাবার আগে 


© রক্ত পাতলা রাখার ঔষধ রাতে খাবার পর এবং 


© হার্টের ঔষধ সেহরি ও ইফতারে খাবেন৷


# প্রষ্টেটের ঔষধঃ  আগের সময়েই (রাতে) খাবেন৷


# ভিটামিনঃ  


© একবেলা থাকলে রাতের খাবারের পর খাবেন৷ 


© দুইবেলা থাকলে, সেহরী আর ইফতারের পর খাবেন৷


# গ্যাসের বড়িঃ 


© সেহরীতে ১৫-২০ মিনিট আগে খাবেন৷  


© ইফতারে গ্যাসের বড়ি খেয়ে সাথে সাথেই ইফতার শুরু করবেন৷


২. ডায়াবেটিস কখন মাপবেনঃ


* বিকেল তিনটা থেকে চারটার মধ্যে একবার মাপবেন৷ এই সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে, আপনার সেহরীর ঔষধ এবং ইনসুলিনের ডোজ adjust করতে হবে৷


* আরেকবার মাপবেন, ইফতারের দুই ঘন্টা পর৷ এই সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে, আপনার ইফতারের ডায়াবেটিসের ঔষধ এবং ইনসুলিন adjust করতে হবে৷


* কখনো খারাপ লাগলে, যেমন অতিরিক্ত দূর্বলতা বোধ করা, প্রচন্ড ক্ষুধা লাগা, অনেক বেশি ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি সময়ে ডায়াবেটিস মেপে দেখবেন এবং সুগার ৩.৮ এর কম পেলে রোজা ভেঙে ফেলবেন৷৷


* আঙ্গুল থেকে রক্ত নিয়ে, গ্লুকোমিটারে সুগার মাপলে, রোজার কোন ক্ষতি হবেনা৷


৩. কখন রোজা ভেঙে ফেলবেনঃ


* খুব অসুস্থ বোধ করলে

* রোজা অবস্থায় সুগারের মাত্রা ৩.৮ এর কম পেলে৷

* সেহরী করতে না পারলে৷


৪. রোজায় খাওয়া দাওয়ার নিয়মঃ


* সেহরী শেষ সময়ের কাছাকাছি সময়ে করবেন, বেশী আগে না৷


* ইফতার করতে হবে আজানের সাথে সাথে৷ ইফতার শেষ করে মাগরীবের নামাজ পড়াই ভালো৷ পানি মুখে দিয়ে একটি খেজুর খেয়েই অনেকে নামাজে দাঁড়িয়ে যান, এটা ইনসুলিন বা ঔষধ গ্রহনকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে৷


* ইফতার থেকে সেহরী পর্যন্ত প্রচুর পানি এবং তরল খাবেন৷ যেমনঃ ডাবের পানি, শরবৎ (কম চিনিযুক্ত বা চিনিবিহীন), দুধ, টক দইয়ের লাচ্ছি, ডাল ইত্যাদি৷


* ইফতারে ভাজাপোড়া এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাবেন৷


* সেহরী এবং ইফতারে আঁশযুক্ত খাবার বেশী খাবেন৷ যেমনঃ ভাত, রুটি, সব্জি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ফলমূল, সালাদ ইত্যাদি৷


* অনেকে রাতের খাবার খেতে চান না, এটাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়৷ রাত দশটার দিকে রাতের খাবার খেয়ে নিলে ভালো হয়৷


* মনে রাখবেন, দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরীর পরিমান রোজায়ও একই থাকবে৷ অর্থাৎ এখন ১৬০০ ক্যালরীর খাবার খেলে, রোজাতেও একই পরিমান খেতে হবে৷ ইফতার, রাতের খাওয়া এবং সেহরি দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করতে হয়, রাতের খাবার না খেলে ক্যালরী ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে৷


৫. রোজা রেখে ব্যায়াম করার নিয়মঃ


* ইফতারের পর বা রাতের খাবারের পর ব্যায়াম করবেন বা হাঁটবেন - দিনের অন্য কোন সময়ে নয়৷

* পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং ২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ যারা পড়বেন, তাদের ব্যায়াম বা হাঁটার দরকার নেই৷


৬. রোজা রেখেও কোন কোন ঔষধ ব্যবহার করতে পারবেনঃ


* চোখ ও কানের ড্রপ

* চামড়ায় লাগানোর ক্রীম

* সাপোজিটরী

* অক্সিজেন

* ইনজেকশন (তবে শিরাপথে দেয়া পুষ্টির ইনজেকশন নয়)

* জিহবার নীচে দেবার ট্যাবলেট বা স্প্রে (হার্টের ব্যথা উঠলে)৷


৭. রোজায় ডায়াবেটিসের ঔষধের ডোজ কেমন হবেঃ


* যাদের ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রনে আছে অর্থাৎ খালি পেটে সুগার ৫ থেকে ৬.৫ এবং তিন বেলাতেই খাবার দুঘন্টা পরের সুগার ৮ থেকে ১০ এর মধ্যে থাকে, তাদের রোজার সময় ঔষধ খাবার বা ইনসুলিন নেবার নিয়ম হলো:


* ডায়াবেটিসের ঔষধ এবং ইনসুলিন রাতের ডোজ গুলো অর্ধেক হয়ে সেহরীতে যাবে আর সকালের গুলো পূর্ণ ডোজেই ইফতারে চলে আসবে৷ এটা হলো simple ফর্মূলা৷ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে এই ফর্মূলা প্রযোজ্য নয়৷


* যারা কেবল একবেলা (রাতে) Basal Insulin নিচ্ছেন যেমনঃ Lantus/Abasaglar/Tresiba/Levemir ইত্যাদি তারা একই ডোজ রাতের একই সময়ে নিতে পারেন৷ 


তবে যাদেরকে Basal insulin এর সাথে অন্য ইনসুলিন বা ঔষধ ব্যবহার করতে হচ্ছে, তাদের ডোজ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে৷ 


* অন্যান্য combination formulation এর ঔষধগুলো রোজার আগে আপনার সুগারের মাত্রা অনুযায়ী আপনার ডাক্তার নির্ধারণ করে দিবেন৷


* তিনবেলা ঔষধ বা ইনসুলিন যাদের চলছে, রমজানের আগে তাদের তিনবেলার সুগারের মাত্রা জেনে এবং রমজানে তাদের পরিবারের খাবার ধরন এবং মেন্যু জেনে, ডাক্তার তাদের রমজানের প্ল্যান এবং ডোজ নির্ধারণ করে দিবেন৷


৮. রোজা রাখা কাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরুৎসাহিত করা হয়ঃ


* যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত (খাবার পর সুগার ১৪ এর বেশী থাকে)

* গুরুতর কিডনী সমস্যা থাকলে

* চোখের রেটিনায় গুরুতর সমস্যা থাকলে

* নিউরোপ্যাথি বা নার্ভে সমস্যা থাকলে

* যারা হাইপো হলে বা সুগার কমে গেলেও বুঝতে পারেননা৷

* যাদের হার্টে গুরুতর সমস্যা

* গর্ভবতী 

* ক্যান্সারের রোগী

* যাদের তীব্র পেপটিক আলসার 

* গুরুতর এজমা রোগী

* লিভারে সমস্যা থাকলে

* গুরুতর মানসিক সমস্যা থাকলে৷


সবার জন্য রইলো পবিত্র রমজানের শুভকামনা৷ আল্লাহ আপনাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন এবং বরকতময় রোজা সুন্দরভাবে পালনের তৌফিক দান করুন৷ 

লেখক : 


ডা. মোঃ এজাজ বারী চৌধুরী
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ এবং হেড অব ডায়াবেটিস সেন্টার,
মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস, ধানমন্ডি৷
সিটি হাসপাতাল, লালমাটিয়া, ঢাকা। 


আরও দেখুন:

ইভেন্ট স্ট্রিম : ডায়াবেটিস