শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়

শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়

- ছবি: সংগৃহীত

শ্রবণক্ষমতা একজন স্বাভবিক মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট। সারাবিশ্বে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পাওয়া মানষের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪৬৬ মিলিয়ন মানুষ এই সমস্যার ভুক্তভুগি। এর মধ্যে ৩৪ মিলিয়নই শিশু। সংস্থাটি আশঙ্কা করছে ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ৯০০ মিলিয়নের বেশি হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে  পূর্ণবয়ষ্ক ব্যাক্তি যদি ৪০ ডেসিবেল এবং শিশুরা যদি ৩০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ শুনতে না পায় তাহলে তাকে শ্রবণ অক্ষম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। শ্রবণ ক্ষমতা হারানো মানুষদের অধিকাংশই নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর।

ধারণা করা হয় ৬৫ বছর বয়সের পরে এক তৃতীয়াশ মানুষই শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া প্যসিফিক এবং আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষদের মাঝে শ্রবণশক্তি হারানোর মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার কারণ: সাধারণত দুইভাবে শ্রুতিশক্তি কমে যায়। প্রথমত জন্মগত কারণে এবং পারিপার্শিক কারণ।

জন্মগত কারণ: একটি শিশু গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের সময় শ্রবণত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে। সাধারণত বাবা-মায়ের জেনেটিক কারণে এবং গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের সময় কিছু জটিলতার কারণে শ্রুতি শক্তি হারাতে পারে। যেমন:-

গর্ভাবস্থায় মাতৃ রুবেলা, সিফিলিস অথবা অন্য কোনো ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।

কম ওজন নিয়ে জন্মালে।

জন্মের সময় অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে।

গর্ভের সময় নিদৃষ্ট কিছু ওষুধ যেমন, অ্যামিনোগ্লাইকোসাইডস, সাইটোঅক্সিক ড্রাগস, অ্যান্টিমেলারিয়াল ড্রাগস খেলে ।

জন্মের পর পরেই মারাক্তক জন্ডিসে আক্রান্ত হলে।

অর্জিত কারণ: পারিপার্শিক কারণে যে কোনও বয়সে শ্রুতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। পারিপার্শিক কারণগুলো হচ্ছে-

ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে মেনিনজাইটিস সংক্রমণ, হাম জাতীয়ে রোগের সংক্রমণ।

দীর্ঘস্থায়ী কানের সংক্রমণ।

কানে তরলজতীয় পদার্থ জমে থাকা।

ম্যালেরিয়া, যক্ষা এবং ক্যান্সার জাতীয় রোগের প্রতিরোধে অতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার।

মাথা এবং কানে আঘাত পেলে।

অতিরিক্ত শব্দ, যেমন পেশাগত কারণে যন্ত্রপাতির অতিরিক্ত শব্দ, হটাৎ কোনও বিষ্ফোরণ।

অতিরিক্ত আওয়াজে অডিও ডিভাইসের ব্যাবহার, দীর্ঘ সময় কনসার্ট, নাইটক্লাব, ক্রীড়া ইভেন্টে উপস্থিত থেকে উচ্চস্বরে শব্দ শ্রবণ।

বার্ধক্য অবস্থায়, এসময় বিশেষ সংবেদনশীল কোষগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

মোম বা ফরেন বডির মাধ্যমে কানের বিশেষ নালিগুলো বন্ধ হলে।

শ্রুতিশক্তি হ্রাস পাওয়ায় প্রভাবগুলো:-

কর্মক্ষমতায় প্রভাব:  শ্রুতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পারস্পারিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। শ্রুতিশক্তি হ্রাস পাওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে মৌখিব ভাষ  শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। শিশুদের একাডেমিক কর্মক্ষমতায় বিরুপ প্রভাব ফেলে। এসব শিশু শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায়শই ব্যার্থ হয় এবং তাদের জন্য অতিরিক্ত পরিচর্যার প্রয়োজন দেখা দেয়। অভিজ্ঞতার কারণে অনেক সময় সফল হতে পারে, তবে সেই সংখ্যা খুবই কম।

সামাজিক প্রভাব: শ্রুতিশক্তি কমে যাওয়া মানুষদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় দৈনন্দিন জীবনের যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে। শ্রুতিশক্তি কমে যাওয়া মানুষগুলো এককিত্ব অনুভব করে, নিজেকে আলাদা করে ফেলে, এক সময় নিজেকে পরাজিত মনে করে। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে শ্রুতিশক্তি কমে গেলে এই সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি অনুভূত হতে থাকে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া মানুদের চিকিৎসায় বিশ্বে বৎসরে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য  ব্যয়, শিক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যয়, উৎপাদনশীল কাজ হ্রাস পাওয়া, সামাজিক ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রুতিশক্তি কমে যাওয়া শিশুদের সহায় স্কুলের সংখ্যা খুবই কম। তাই অনেক সময় তারা পড়ার সুযোগ পায় না। শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। যাঁর বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয় তারাও তুলুনামূলক কম গ্রেডে চাকরি করে থাকেন।

শ্রুতিশক্তি কমে যাওয়া মানষগুলোকে কারিগরি শিক্ষারার আওতায় এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া  দরকার। এজন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্ব দুর করাই হতে পারে এই সমস্যার সমাধান।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অর্ধেক ক্ষেত্রে শ্রুতিশক্তি কমে যাওয়ার কারণগুলো প্রতিরোধ করা যায়। ১৫ বছরের কম বয়সে শ্রুতিশক্তি হ্রাস পেলে ৬০ শতাংশক্ষেত্রে সেটা প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধযোগ্য কারণগুলি হচ্ছে:-

ম্যামপাস, হাম, ‍রুবেলা, মেনিনজাইটিস, সাইটোমেগালোভাইরাস, ওটিটিস ভাইরাস থেকে ৩০ শতাংশ সংক্রমণ ঘটে।

জন্মের সময়ের কিছু জটিলতা যেমন, অ্যাসিফিক্সিয়া, জন্মের সময় ওজন কম থাকা, সময়ের আগে জন্মগ্রহণ, এবং জন্ডিসের কারণে শ্রুতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার মাত্রা ১৭ শতাংশ।  

বাচ্চা এবং মায়ের চাহিদা অনুযায়ী অটটক্সিন ওষধের ব্যাবহারের কারণে ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে শ্রুতিশক্তি হ্রাস পায়।

শ্রবণশক্তি হ্রাস রোধে জাতিসংঘের কয়েকটি কৌশলগত নির্দেশনা:-

 বাচ্চা জন্মের পর কিছু শৈশব রোগ যেমন হাম, মেনিনজাইটিস, রুবেলা, ম্যাম্পস রোগের টিকা  দেওয়া।

কিশোরি মেয়েদের এবং বাচ্চা নিতে যাওয়া মায়েদেরকে গর্ভধারণের আগেই রুবেলা টিকা দেওয়া।

গর্ভবতী মায়েদের কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন, সাইটোমেগালাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ, সিফিলিস এবং অন্যান সংক্রমণ নিয়মিত স্ক্রিনিং এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই ত্রুটি দুর করা যায়।

সন্তান প্রসব প্রক্রিয়া নিরাপদ করার জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা জোরদার করা।

নিয়মিত কানের যত্ন নেওয়া।

পেশাগত ক্ষেত্রে এবং বিনোদনমূলক অনষ্ঠানে অতিরিক্ত শব্দ এড়িয়ে চলা এবং এর ঝুকি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করা। কানে অতিরিক্ত শব্দ যাতে না প্রবেশ করতে পারে এমন কিছু ডিভাইস যেমন, ইয়ারপ্লাগ, শব্দপ্রতিরোধী ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যাবহার করা।

শিশুদের ওটিটিস মাধ্যমগুলো নিয়মিত স্ক্রিনিয় করা, যথাযথ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করা।

শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস করে এমন ওষুধ থেকে বিরত থাক, এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়া।

সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা