তোমরা যারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ

তোমরা যারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ

মেডিকেল শিক্ষা
তোমরা যারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ (ইনসেটে ডা. গুলজার হোসেন) - ফাইল ছবি

১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সম্ভবত শেষ সপ্তাহে আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল বের হয়েছিলো। আমি তখনো কনফিউজড ছিলাম এই ভেবে যে "কাজটা কি ঠিক হলো? এই কূল হারা সমূদ্র আমি কি করে পাড়ি দিব?"

একদিকে সাফল্যের আনন্দ। একটা নতুনতর জীবনের হাতছানি। ডাক্তারি পেশাও ভাল লাগতো। কিন্তু লেখাপড়া করতে হয় অনেক। বারবার মনে হচ্ছিল আমি কি পারব ধৈর্য রাখতে? এরকম নানাবিধ ভয় মনের মধ্যে এক মিশ্র অনুভুতির সৃষ্টি করেছিল। লিখে বোঝাতে পারবোনা৷

কনফিউশনের কারণে রেজাল্টের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম কিনে এনেছিলাম। ফার্মগেট থেকে টেম্পুতে করে আসার পথে আরেক পাপীকে পেলাম, সেও মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। রংপুর মেডিকেল। ছেলেটি খুব বাচাল। নিজেই টেম্পুতে আলাপ তুলল "আমি মেডিকেলে টিকলাম। বুঝতেছিনা কি করব। রংপুর মেডিকেল। জীবনে তো ঢাকার বাইরে কোথাও যাইনি। তুমি কি কর? "

জাহাংগীর গেটের কাছে এক এপ্রোন পরা ভদ্রমহিলা উঠলেন টেম্পুতে। ছেলেটি এক্সকিউজ মি বলে তার কাছে গিয়ে বসল। তারপর আবার আলাপ "ম্যাডাম, আপনি কি ডাক্তার? আমি আজকে মেডিকেলে টিকলাম। রংপুর মেডিকেল। বুঝতেছিনা ভর্তি হব কিনা। রংপুর মেডিকেলে লেখাপড়া হয়? রোগী আছে? প্রোপার ইন্সট্রুমেন্ট আছে?"

ভদ্রমহিলা একগাল হেসে বললেন মেডিকেলের লেখাপড়া নিজের কাছে৷ আর ডাক্তারির সাফল্য হলো ক্লিনিক্যাল আই। যার ক্লিনিক্যাল আই যত ভাল সে তত ভাল ডাক্তার। এটা যার যার শার্প নেস।

সেই প্রথম আমি 'ক্লিনিক্যাল আই' শব্দটা শুনলাম। আমি চিকন সুরে বললাম "আমিও চান্স পেয়েছি- কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে। আমিও বুঝতেছিনা কি করব? "

পাশ বসা এক ভদ্রলোক বললেন মেডিকেল পড়তে মন চাইলে পড়। আর ভাল না লাগলে এলাকায় গিয়া ডিগ্রীতে ভর্তি হও। ডিগ্রী পাশ করে এডমিনে বিসিএস দিও। যদি নিজেকে ব্রিলিয়ান্ট মনে কর, তাহলে বিসিএস দাও। পাশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যাবা।

টেম্পুতে বসা আরেক ভদ্রলোক বললেন আজকাল ডাক্তারদের চাকরিবাকরি নাই। বিসিএস না হইলে ক্লিনিকে ডিউটি, নাইলে এঞ্জিও ভরসা। তোমাদের সময় আসতে আসতে ফার্মেসিতে বসার জন্য ইন্টারভিউ দেওয়া লাগবে।

কথাবার্তা ভাল লাগছিলনা। আমিও আর আওয়াজ করিনাই। কিন্তু ঐ ছেলেটা বক বক করেই যাচ্ছিল। খুব ইউফোরিক ছিল মে বি। বারবার বলছিল রংপুর মেডিকেল..... জানিনা কি হবে।
তোমরা আজকে যারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ তাদেরকেও এসব কথা শুনতে হবে। ঘাবড়ে যেওনা। লক্ষে অবিচল থাকবে। তোমাদের জন্য আমার অভিনন্দন রইল। দেখা হবে বিজয়ে।
শুধু একটাই কথা। মেডিকেলে তোমরা যে ভর্তি হচ্ছ সেটা নিজের ইচ্ছায় হচ্ছ কিনা ভেবে দেখো। এটা একটা কঠিন জীবন। দীর্ঘ সময়ের সাধনা, ত্যাগ, কষ্ট তোমাকে মেনে নিতে হবে। নিজেকে একটা ভিন্ন জীবনপদ্ধতিতে সঁপে দিতে হবে। এসব মানতে পারবে তখনই যখন এই পেশাকে তুমি মন থেকে ভালবাসবে। প্রেম না থাকলে তো ত্যাগ আসেনা। পেশার প্রতি ভালবাসা না থাকলে, মানুষের প্রতি ভালবাসা না থাকলে এই পেশাকে তোমার খুবই অসহনীয় মনে হবে৷

এই পেশায় চ্যালেঞ্জ আছে। সব পেশাতেই আছে৷ কিন্তু এখানে তুমি সাধারণ মানুষের অকুন্ঠ ভালবাসা পাবে। একটুখানি উজাড় করে দিলে অনেকখানি ফেরত পাবে। প্রতিটি অনেস্ট ইফোর্টের তুমি প্রতিদান পাবে।

আর যদি তোমার মনে ন্যুনতম অনীহা থাকে এই পেশার প্রতি- তাহলে প্লিজ এখানে এসোনা৷ নিজের ভাললাগাকে মূল্য দাও। অনীহা নিয়ে এই পেশাতে যারা এসেছে তারা হয়ত পাশ করে, উচ্চতর ডিগ্রী করে, বড় ডাক্তারও হয়ত হয়। কিন্তু পেশার প্রতি তাদের সেই অশ্রদ্ধা, অভক্তি থেকেই যায়৷ এর প্রভাব পড়ে এদের আচরণে। প্রভাব পড়ে রোগীদের উপর।

আগের জমানা তো এখন নেই। কত কত নতুন সেক্টর বিকশিত হয়েছে৷ যারা খুব মন দিয়ে কাজ করে, সিনসিয়ারলি কাজ করে, তারা যেখানেই যাক খুব ভাল করে। জীবন একটাই। যেখানে তোমার ভাল লাগা সেখানেই যাও। সেখানেই তুমি সবচেয়ে বেশি ভাল করবে৷ বাবা মা যদি বলেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হইলে ভাত নাই তুমি শুনবে কিন্তু মানবেনা।

এই মুহুর্তে বাংলাদেশে ডাক্তারি পেশাটার একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। এর জন্য বড়রা দায়ী। আমাদের দেশের একদল লোভী মানুষ ব্যাবসা করার সহজ পদ্ধতি হিসেবে অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ বানিয়ে ফেলেছে৷ এত মেডিকেল কলেজের প্রয়োজন আমাদের ছিলনা। বেহিসাবে ডাক্তার উৎপাদনের কারণে মান হারিয়েছে। ডাক্তারদের চাকরির বাজারেও একটা তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কাজটা খুব খারাপ হয়েছে। তবে নিশ্চয়ই তার সমাধান হবে৷ সমস্যা তো চিরকাল থাকেনা। আস্তে আস্তে হয়ত মানহীন মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বন্ধ হবার পথে৷

ক্যাডার সার্ভিসে বৈষম্য আছে। যেটা আমাদেরকে মানসিকভাবে খুব পীড়া দেয়৷ কিন্তু কি আর করা যাবে৷ তৃতীয় বিশ্বের দেশে আমলা, পুলিশ, সৈনিক এদের দৌরাত্ম থাকেই। একদিন নিশ্চয়ই এসবও পালটাবে। বৈষম্য চিরকাল থাকেনা।

দেশের বাইরে চাকরির অনেকগুলো নতুন পথ খুলেছে। এমআরসিপি পরীক্ষা দিচ্ছে আজকাল প্রচুর ছেলে মেয়ে৷ বাইরে চলে যাচ্ছে৷ তোমরাও বাইরে যাবার চেষ্টা করতে পার। মেধাপাচার বা ব্রেইন ড্রেইনের কন্সেপ্ট এখন আর নেই। পুরো পৃথিবীটাই মানুষের।

এটা ঠিক এমবিবিএস করলেই লাইফ সেট। শুধু টাকা আর টাকা - এই কনসেপ্ট এখন আর নেই৷ কিন্তু পরিশ্রম করলে, ইতিবাচকতার সাথে চেষ্টা করলে ভালভাবেই জীবন যাপন করা সম্ভব। দক্ষতা অর্জন করতে পারলে শুধু একটা কাজ দিয়েই অনেক উপার্জন করা সম্ভব৷
যারা তোমাদেরকে ডাক্তারি বিদ্যায় চান্স পাওয়া নিয়ে নেতিবাচক কথা বলবে তুমি ধরে নেবে এরা ব্যক্তিগতভাবে হতাশ মানুষ। তুমি যাই করবে এরা নেতিবাচক কথা বলবে। এদের কথায় দমে যাবেনা। যদি এই পেশাকে খুব বেশি ভালবাসো তবে এর হার্ডশিপকেও আপন করে নাও। এই পেশা তোমারই জন্য।

একটা মজার কথা বলি। আমার এক সহকর্মী সারাদিন মেডিকেল প্রফেশন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলতো। আজ দেখলাম তিনি সন্তান সরকারি মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় বেজায় খুশি। পোস্টও দিয়েছেন৷ অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ডাক্তার এখনো তার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চান৷

লেখকঃ

ডা. গুলজার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।


আরও দেখুন: